আমেরিকান সমাজের অবক্ষয়: পরিবারের ভাঙন ও তার প্রভাব

বর্তমান আমেরিকান সমাজে পরিবার কাঠামোর ক্রমাগত অবক্ষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এই ভাঙন শুধু ব্যক্তিগত জীবনে নয়, বরং সামাজিক ও মানসিক স্বাস্থ্যে গভীর প্রভাব ফেলছে। বিভিন্ন গবেষণা ও তথ্যের আলোকে, আমেরিকার অধিকাংশ পরিবার আজ ফাঁপা খোলসে পরিণত হয়েছে। এটি সমাজে বিভিন্ন ধরনের অস্থিরতা ও অসুখের জন্ম দিচ্ছে।

পরিবারের ভাঙন: বাস্তব চিত্র

আসুন দেখি, কীভাবে আমেরিকান সমাজের পরিবার কাঠামো ভেঙে পড়ছে। সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, আমেরিকায় জন্ম হওয়া মোট শিশুর প্রায় ৪১%-ই হলো বিয়ে বহির্ভূত প্রেমের ফসল। অর্থাৎ, এই শিশুরা জন্ম নিচ্ছে এমন পরিবারে, যেখানে তাদের বাবা-মা বিয়ে করেননি। এমনকি বিয়ে করা দম্পতিদের মধ্যেও বিচ্ছেদের হার অনেক বেশি। শ্বেতাঙ্গদের মধ্যে প্রতি ৪ জনে ১ জনের ঘরে বাবা নেই, এবং আফ্রিকান আমেরিকানদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যা আরও বেশি, ১০০ জন শিশুর মধ্যে ৬৫ জনের ঘরেই বাবা নেই।

এই পরিসংখ্যানগুলো একটি বিপজ্জনক সামাজিক বাস্তবতাকে নির্দেশ করে—একটি পুরো প্রজন্ম বেড়ে উঠছে বাবা-মায়ের ছায়া ছাড়া, একটি পূর্ণাঙ্গ পরিবারের অভাব নিয়ে। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, বা শুধুমাত্র মায়ের অধীনে সন্তান পালনের ফলে শিশুর মানসিক ও আত্মিক গঠনে যে প্রভাব পড়ে, তা অত্যন্ত নেতিবাচক।

বাবা-মা ছাড়া বড় হওয়া শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক প্রভাব

বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ বা অনুপস্থিতি শিশুদের মনস্তাত্ত্বিক এবং সামাজিক বিকাশে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। একাধিক গবেষণা প্রমাণ করেছে যে, বিচ্ছিন্ন পরিবারের সন্তানদের অপরাধে জড়িত হবার প্রবণতা বেশি থাকে। এরা পড়াশোনায় খারাপ করে, স্কুল থেকে ঝরে পড়ে এবং দরিদ্রতা, বৈষম্যের মধ্যে বড় হয়।

এই সব শিশুরা মানসিক জটিলতায় ভুগে থাকে এবং প্রায়ই অপরাধের দিকে ঝুঁকে পড়ে। অল্প বয়সী খুনি, সিরিয়াল কিলার, ম্যাস কিলার, মাদকসেবী, মাদক ব্যবসায়ী, ধর্ষক, মাস্তান, গ্যাং মেম্বার, এবং বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক জটিলতায় ভোগা মানুষদের মধ্যে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য দেখা যায়—তাদের ঘরে বাবা নেই, তাদের বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ হয়েছে।

লিভ-ইন সম্পর্কের শিশুদের প্রভাব

লিভ-ইন সম্পর্ক থেকে জন্ম নেওয়া শিশুদের মধ্যেও অপরাধ প্রবণতা বেশি দেখা যায়। লিভ টুগেদার করা যুগলদের বাচ্চাদের ৪২% এর মধ্যে বন্ধুদের ধরে মারপিট করার প্রবণতা দেখা যায়, যা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি। এদের কারাগারে যাবার সম্ভাবনাও স্বাভাবিক পরিবারের বাচ্চাদের তুলনায় ১২ গুণ বেশি।

সমাজে অস্থিরতা ও সামাজিক অসুখ

একটা সভ্যতাকে ধ্বংস করে দেবার জন্য এমন বাবা-মা ছাড়া, বিবাহ বহির্ভূতভাবে জন্ম নেওয়া, স্থায়ী পরিবার ছাড়া বেড়ে ওঠা একটা জেনারেশনই যথেষ্ট। বেগতিক অবস্থা দেখে বিবাহ বহির্ভূত যৌনতাকে পূজা করা পশ্চিমারাই এখন বলতে শুরু করেছে শিশুর বেড়ে ওঠার জন্য সবচেয়ে আদর্শ ব্যবস্থা হলো বিয়ের পবিত্র বন্ধনে গড়ে ওঠা পরিবার।

সস্তা প্রেম আর যৌনতাকেন্দ্রিক চিন্তাধারা সমাজেও অস্থিরতা তৈরি করে। জন্ম দেয় নানা সামাজিক অসুখের। পারিবারিক বন্ধনের মতো পশ্চিমে সমাজ ব্যবস্থাও ভেঙে পড়েছে। ওদের তরুণ-তরুণীরা ক্ষুব্ধ, একা। ওরা বিভ্রান্তিতে ভুগছে আত্মপরিচয়, নিজের দেহ, পৃথিবীতে নিজের অবস্থান ও ভূমিকা—সবকিছু নিয়েই।

মানসিক স্বাস্থ্য ও আত্মহত্যা

আমেরিকান ও কানাডিয়ান তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্য পরিস্থিতি ভয়াবহ। ছোট্ট বয়সেই হতাশা, অবসাদ, ক্লেদ জাঁকিয়ে বসেছে। প্রতি ৫ জনে একজন মনোযাতনায় ভুগছে। কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণীদের মধ্যে মানসিক সমস্যার কারণে আত্মহত্যার হার বেড়ে গিয়েছে। আমেরিকার টিনেজারদের মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ হলো আত্মহত্যা।

পশ্চিমা সমাজের অবক্ষয়ের কারণ

পশ্চিমের তরুণ সমাজকে যে বৈশিষ্ট্যগুলো গ্রাস করে নিচ্ছে সেগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো—অপরিপক্কতা, আত্মকেন্দ্রিকতা, দায়িত্বজ্ঞানহীনতা, ঔদ্ধত্য, অস্থিরতা এবং আত্মমুগ্ধতা। আর এই অসুখগুলো দিন দিন ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের মাঝেও।

বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কের প্রতি আগ্রহ, পারিবারিক মূল্যবোধের অবনতি এবং সামাজিক অস্থিরতা পশ্চিমা সমাজের অবক্ষয়ের মূল কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের সমাজে এই ধরনের মানসিকতা এবং সামাজিক চর্চা অনুসরণ করলে আমাদের সমাজও ধ্বংসের পথে চলে যেতে পারে।

আমেরিকান সমাজের পরিবার কাঠামো আজ চরম সংকটের মুখোমুখি। বাবা-মায়ের বিচ্ছেদ, লিভ-ইন সম্পর্কের শিশুদের অপরাধ প্রবণতা, মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা এবং আত্মহত্যার হার এই সংকটের কিছু দিক মাত্র। পশ্চিমা সমাজের এই অবক্ষয় আমাদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। পরিবার কাঠামোর এই ধ্বংস আমাদের সমাজকেও ধ্বংসের পথে ঠেলে দিতে পারে, যদি আমরা সতর্ক না হই। আমাদের উচিত পরিবার কাঠামোকে মজবুত করে তোলা এবং সমাজের ভিত্তি পুনর্গঠন করা। পরিবার হল সমাজের মূল ভিত্তি এবং এই ভিত্তি শক্ত না হলে কোনো সমাজই টিকে থাকতে পারে না।

আমাদের উচিত পরিবারকে প্রাধান্য দেওয়া, বিবাহের পবিত্রতা বজায় রাখা এবং সমাজে নৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম একটি সুস্থ ও স্থিতিশীল সমাজে বেড়ে উঠতে পারে।

Thanks For Comment we are reply soon as possible.

Previous Post Next Post