ইসলামবিদ্বেষ এবং সেক্যুলারায়নের বর্তমান প্রবণতা সমাজে এক গভীর সংকটের সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে বাংলার মুসলিমদের জন্য এটি একটি বিশেষ চ্যালেঞ্জ। আমাদের দ্বীন এবং আত্মপরিচয় টিকিয়ে রাখতে হলে কেবল কিছু উপায় গ্রহণ করাই যথেষ্ট নয়; বরং আমাদের দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা প্রয়োজন। এই ব্লগে, আমরা ইসলামের আত্মপরিচয় টিকিয়ে রাখতে ৫টি মূল ধারণা নিয়ে আলোচনা করব।
১. সামাজিক আধিপত্য (Cultural Hegemony)
সামাজিক আধিপত্য বলতে বোঝানো হয় যখন একটি গোষ্ঠী সমাজের রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, এবং অর্থনৈতিক ক্ষমতা দখল করে রাখে এবং অন্যদের উপর নিজেদের মতবাদ চাপিয়ে দেয়। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে সেক্যুলার-প্রগতিশীল গোষ্ঠী এই আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা এমন একটি সামাজিক কাঠামো তৈরি করেছে যা ইসলাম ও মুসলিমদের "অপর" এবং "শত্রু" হিসেবে দেখে। ইসলাম ও মুসলিমদের আত্মপরিচয় টিকিয়ে রাখতে হলে এই আধিপত্য ভাঙ্গা জরুরি। এজন্য আমাদের সমাজে এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করতে হবে যেখানে ইসলামের আদর্শিক এবং নৈতিক শক্তি সমাজের মূলধারায় ফিরে আসতে পারে।
২. সাংস্কৃতিক যুদ্ধ (Kulturekampf)
সাংস্কৃতিক যুদ্ধ একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার যা সেক্যুলার-প্রগতিশীল গোষ্ঠীর সামাজিক আধিপত্য ভাঙতে ব্যবহার করা যেতে পারে। সাংস্কৃতিক যুদ্ধের মাধ্যমে সমাজের যে বিভাজন প্রচ্ছন্নভাবে আছে তা স্পষ্ট করে তুলে ধরা সম্ভব। এ যুদ্ধের মাধ্যমে ইসলামের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে সমাজের মূল প্রশ্নে পরিণত করা উচিত। সাংস্কৃতিক যুদ্ধ মানে এখানে কেবল শারীরিক যুদ্ধ নয়, বরং এটি হলো আদর্শের যুদ্ধ। এজন্য আমাদের সামাজিক মিডিয়া, সাহিত্য, সংগীত, এবং শিক্ষার মাধ্যমে ইসলামের প্রকৃত সৌন্দর্যকে প্রচার করতে হবে।
৩. আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা ও সমস্যা নিয়ে আলোচনা
ইসলামকে একটি কার্যকরী বিকল্প হিসেবে উপস্থাপন করতে হলে আর্থ-সামাজিক বাস্তবতা এবং সমস্যা নিয়ে ইসলামের অবস্থান থেকে আলোচনা করা জরুরি। এক্ষেত্রে শুধু ব্যক্তিগত জীবনধারণে দ্বীনের নাসীহাহ বা সেক্যুলার ব্যবস্থার সমালোচনা করে কিছু হবে না। বরং ইসলাম কীভাবে সমাজের আর্থ-সামাজিক সমস্যাগুলোর সমাধান দিতে পারে তা তুলে ধরতে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ইসলামের জাকাত ব্যবস্থা কীভাবে দারিদ্র্য বিমোচনে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে, কীভাবে ইসলামী অর্থনীতি সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে পারে—এই বিষয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে।
৪. সামাজিক শক্তি অর্জন
সামাজিক শক্তি অর্জন হলো সাংস্কৃতিক যুদ্ধ এবং ইসলামী বিকল্পের আলোচনা সাধারণ মানুষের কাছে পৌছে দেওয়ার মাধ্যম। এর জন্য, আমাদের তৃণমূলে কাজ করতে হবে এবং বিভিন্ন প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে যেখানে মুসলিমরা একত্রিত হতে পারে। আমাদের তরুণ সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে এবং তাদের এমন একটি প্ল্যাটফর্ম দিতে হবে যেখানে তারা ইসলামের পক্ষে তাদের মতামত প্রকাশ করতে পারবে। যেমন: ইসলামিক সোশ্যাল মিডিয়া গ্রুপ, ইভেন্ট, সেমিনার, এবং বিতর্কের মাধ্যমে আমরা আমাদের সমাজে ইসলামের পক্ষে শক্তিশালী মতামত তৈরি করতে পারি।
৫. মেটাপলিটিক্স (Metapolitics)
মেটাপলিটিক্স হলো একটি বিস্তৃত ধারণা যা সমাজের গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশের চিন্তার ধরন এবং ওয়ার্ল্ডভিউ পরিবর্তনের জন্য ব্যবহৃত হয়। আমাদের মূল লক্ষ্য হলো মানুষের চিন্তা পরিবর্তন করা—যে চিন্তার ওপর ভিত্তি করে তাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক অবস্থান নির্ধারিত হয়। আমাদের প্রচেষ্টা হলো এই পরিবর্তনের মাধ্যমে সমাজের ভেতরের কাঠামো পরিবর্তন করা, যেখানে ইসলামের মূল ভিত্তিকে সমাজের কেন্দ্রস্থানে স্থাপন করা হবে।
আমাদের রিসোর্স এবং সম্ভাবনা
বাংলাদেশের মুসলিমদের কাছে রয়েছে একটি পূর্ণাঙ্গ নৈতিক, আত্মিক, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা—ইসলামী শরীয়াহ। আমাদের পেছনে ইতিহাস আছে, সাড়ে পাঁচশো বছরের বেশি মুসলিম শাসনের ঐতিহ্য রয়েছে। আমাদের আছে এমন এক আকীদাহ যা আসমান ও যমীনের সব কিছুর চেয়ে বেশি দামি। আমাদের আছে জনশক্তি এবং তরুণ সমাজ যারা ইসলামের পক্ষে সর্বদা প্রস্তুত। আমাদের সাথে আছেন প্রাজ্ঞ আলিমরা, এবং সর্বোপরি আছেন আসমান ও যমীনের একচ্ছত্র অধিপতি আল্লাহ।
ইসলামের আত্মপরিচয় টিকিয়ে রাখতে এবং সেক্যুলার আধিপত্য মোকাবিলা করতে হলে আমাদের সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা, দীর্ঘমেয়াদী প্রচেষ্টা, এবং সর্বোচ্চ ত্যাগ ও সততা নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের এই যাত্রা হবে ঝুঁকিপূর্ণ এবং চ্যালেঞ্জিং, কিন্তু আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস থাকতে হবে যে আল্লাহর সাহায্যে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারব। আমাদের প্রয়োজন সেই অগ্রগামী দলের যারা সমাজের প্রতিটি স্তরে ইসলামের নৈতিক ও সাংস্কৃতিক মূল্যবোধকে প্রতিষ্ঠিত করবে এবং বাংলার মুসলিমদের জন্য একটি নতুন ভোরের সূচনা করবে।
এটা আমাদের চিন্তার দুর্বলতা নয়, বরং আমাদের শক্তি এবং দৃঢ়তা যা বাংলার মুসলিমদের একটি উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ তৈরি করতে সহায়তা করবে। আল্লাহ আমাদের সহায়ক হোন, আমিন।