আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং নাগরিকদের সংকট

আধুনিক রাষ্ট্র ও নাগরিক সম্পর্ক

আধুনিক রাষ্ট্রে প্রত্যেক নাগরিকের সাথে রাষ্ট্রযন্ত্রের একটি সরাসরি সম্পর্ক থাকে, যেখানে কোনো মধ্যস্থতাকারী বা ইন্টারমিডিয়ারি থাকে না। প্রথম দেখায়, এটি নাগরিকদের জন্য সুবিধাজনক মনে হতে পারে। তবে বাস্তবে, এই ধরণের সরাসরি সম্পর্ক প্রায়শই একটি তীব্র ভারসাম্যহীনতা তৈরি করে। রাষ্ট্র যদি যালিম হয়, যদি সে কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষায় নিয়োজিত থাকে, তাহলে এই সম্পর্ক অত্যন্ত বিপজ্জনক হয়ে ওঠে। একদিকে বিশাল, শক্তিশালী রাষ্ট্রযন্ত্র; অন্যদিকে, বিচ্ছিন্ন, দুর্বল, একক ব্যক্তি। এই ধরনের পরিস্থিতিতে রাষ্ট্র তার ইচ্ছামত নাগরিকদের অধীনস্ত ও ধ্বংস করতে সক্ষম হয়।

ঐতিহ্যবাহী সমাজের মডেল

পুরোনো সমাজ ব্যবস্থায়, বিশেষ করে গোত্রীয় সমাজে, ব্যক্তির সাথে শাসকের সম্পর্কের মাঝে তার গোত্র বা সম্প্রদায় একটি মধ্যস্থতাকারী হিসেবে কাজ করত। এই ব্যবস্থা ব্যক্তি এবং রাষ্ট্রের মাঝে একটি সুরক্ষার স্তর তৈরি করত। যখন কেউ মযলুম (নির্যাতিত) হত, তার গোত্র বা সম্প্রদায় তার পক্ষ নিয়ে শাসকের সাথে আলোচনায় বসত, দরকষাকষি করত এবং প্রয়োজনে তাকে আক্রমণ থেকে রক্ষা করত।

গোত্রের অংশ হিসেবে, ব্যক্তি একা নয়, বরং একটি বড় সামষ্টিক সত্ত্বার অংশ। এই সমষ্টির অংশ হওয়ায় তার দুর্বলতা কমে যেত, এবং শাসকের সাথে তার শক্তি ও মর্যাদার পার্থক্যও কিছুটা কমে আসত।

আধুনিক রাষ্ট্রের মনোভাব

আধুনিক রাষ্ট্র কিন্তু সমস্ত ধরনের সমষ্টিগত পরিচয় মুছে দিয়ে শুধুমাত্র জাতীয়তাবাদ এবং নাগরিকত্বকে প্রধান্য দেয়। এখানে ব্যক্তি আর রাষ্ট্রের সম্পর্ককে পারস্পরিক চুক্তির ওপর ভিত্তি করে গড়ে তোলা হয়, কিন্তু বাস্তবে এটি অধিকাংশ সময়ই অধীনস্ততা, নিয়ন্ত্রণ এবং জবরদস্তির ভিত্তিতে গড়ে ওঠে। আধুনিক রাষ্ট্র চায় নাগরিকদের সাথে সরাসরি সম্পর্ক তৈরি করতে এবং সব ধরনের সামাজিক, ধর্মীয়, এবং ঐতিহ্যবাহী গোষ্ঠী বা প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল করে দিতে।

মুসলিম সমাজের উপর আধুনিক রাষ্ট্রের প্রভাব

মুসলিম অধ্যুষিত ভূখণ্ডগুলোতে এই প্রভাব আরো তীব্র। ঔপনিবেশিক শাসনের সময় মুসলিমদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে ধ্বংস করা হয়েছিল। তারপর সেগুলোর স্থানে সেক্যুলার প্রতিষ্ঠান বসানো হয় অথবা সেগুলোকে রাষ্ট্রের অধীনস্ত করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় মুসলিম সমাজে অ্যাটমাইজড (বিচ্ছিন্ন) মানুষ তৈরি হয়েছে, যারা সংখ্যায় অনেক, কিন্তু একে অপরের সাথে বিচ্ছিন্ন।

বিচ্ছিন্নতা এবং দুর্বলতা

এই বিচ্ছিন্নতা থেকে দুর্বলতা আসে। একজন বিচ্ছিন্ন মানুষ বড় কোনো শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না, যেমন শক্তিশালী রাষ্ট্র। সে তার স্বার্থ রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়, পরিবর্তনের ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ে এবং সহজেই বিভিন্ন দ্বিধা, সংশয় আর ভয়ের মধ্যে আটকে যায়।

শক্তি এবং সংগঠনের প্রয়োজন

এই দুর্বলতা কাটিয়ে ওঠার প্রথম ধাপ হল সংগঠিত হওয়া। বিচ্ছিন্ন মানুষ নিজে নিজে যুলুম এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে কার্যকরভাবে লড়তে পারে না। এর জন্য প্রয়োজন একত্রিত হওয়া। ইতিহাসে বড় ধরণের পরিবর্তনের যতো উদাহরণ আছে, সবই কোন না কোন ধরণের সমষ্টিগত প্রচেষ্টার মাধ্যমে অর্জিত হয়েছে।

সমষ্টিগত প্রচেষ্টার উদাহরণ

বিশ্ব ইতিহাসে শ্রমিক আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, ছাত্র আন্দোলন, গেরিলা যুদ্ধ এবং সংখ্যালঘুদের অধিকার আন্দোলন সহ অনেক উদাহরণ রয়েছে, যেখানে মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাদের অধিকার আদায় করেছে।

বাংলাদেশে মুসলিমদের সংগঠিত হওয়ার প্রয়োজন

বাংলাদেশের মুসলিমদের এই মুহূর্তে বাস্তব জীবনে (অনলাইনে নয়) একত্রিত হওয়া প্রয়োজন। বিচ্ছিন্ন মানুষগুলোকে একটি সমষ্টিতে পরিণত করতে হবে, যা তাদের শক্তি ও মর্যাদাকে বাড়াবে। তবে কোনো মূলধারার রাজনৈতিক দল বা বাহ্যিক শক্তি এ কাজে সাহায্য করবে না। বরং এই উদ্যোগে বাধা দেবে। কাজেই, পরিবর্তন আনতে হলে নিজেদের সংগঠিত হতে হবে এবং নিজস্ব প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে হবে।

মুসলিমদের মধ্যে আত্মপরিচয় এবং আত্মবিশ্বাস

প্রথমে, মুসলিমদের মধ্যে আত্মপরিচয় এবং আত্মবিশ্বাসের অনুভূতি জোরালো করতে হবে। তারপর সামাজিকভাবে সংঘবদ্ধ হতে হবে, যাতে মুসলিমরা একত্রিত হতে পারে এবং নিজেদের কথা এবং চিন্তাগুলো সমাজের সামনে তুলে ধরতে পারে।

প্রাথমিক পদক্ষেপ

কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে "ইসলামী ইতিহাস" বা "ইসলামী সভ্যতা ও চিন্তা" কেন্দ্রিক ক্লাব তৈরি করে এই কাজ শুরু করা যেতে পারে।

"ইসলামবিদ্বেষের ব্যাপারে সচেতনতা" সৃষ্টি করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংস্থা তৈরি করা যেতে পারে। আর্থসামাজিক বিভিন্ন ইস্যু নিয়ে ইসলামের অবস্থান বিশ্লেষণ করে গবেষণা সংস্থা তৈরি করাও সম্ভব।

সামাজিক ইস্যু নিয়ে কাজ

সমাজের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান দেয়ার জন্যও কাজ করা যেতে পারে। যেমনঃ পর্নোগ্রাফি, যিনা, মাদক, ডিপ্রেশন, সুইসাইড, পরিবারের ভাঙ্গন, স্ক্রিন আসক্তি, ক্যারিয়ার অ্যাডভাইস ইত্যাদি বিষয়ে ইসলাম কী বলে, তা নিয়ে গবেষণা ও প্রচারণা চালানো যেতে পারে।

উদ্দেশ্য ও কর্মসূচী

মূল আলোচনা সব সময়ে ইসলাম এবং মুসলিম পরিচয়ের উপর ভিত্তি করে থাকতে হবে। ইসলামকে মূল ভিত্তি এবং দিকনির্দেশনা হিসেবে নেয়ার ব্যাপারটা থাকবে দাওয়াহর কেন্দ্রে।

দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা

এই পথ কঠিন এবং দীর্ঘ। রাতারাতি বিশাল কিছু করে ফেলার সুযোগ নেই। কিন্তু ছোট ছোট পদক্ষেপ নিয়ে শুরু করতে হবে। একটি বড় গাছের জন্ম হয় একটি ছোট্ট বীজ থেকে। তেমনি, বড় পরিবর্তনের শুরুটাও ছোট কিছু উদ্যোগ থেকে হতে পারে।

পরিশেষে, পরিবর্তন আনতে হলে নিজেদের মধ্যে ঐক্য গড়ে তুলতে হবে, সমষ্টিগতভাবে কাজ করতে হবে এবং ইসলামের শিক্ষা ও মূল্যবোধকে সমাজের সামনে উপস্থাপন করতে হবে। নিজেদের অধিকার আদায় করতে হলে এবং দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হয়ে থাকার বাস্তবতাকে বদলাতে হলে, নিজেদেরই উদ্যোগ নিতে হবে। আর এই সব কিছুই অর্জন করতে হবে সবর, ফিরাসাহ এবং হিকমাহর সাথে।


Thanks For Comment we are reply soon as possible.

Previous Post Next Post