ইসলামের প্রতি আবু জাহলের অবস্থান

ইসলামের প্রচার ও প্রসার কালীন মাক্কায় এক অসাধারণ যুগের সূচনা হয়েছিল। নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর দাওয়াহ আর ইসলামের শিক্ষার প্রতি বিভিন্ন কুরাইশ নেতা ও সমাজের উপরতলার মানুষদের প্রতিক্রিয়া অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন আবু জাহল, যিনি ইসলামের শত্রু হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তবে আবু জাহলের চিন্তাধারা, ইসলামের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি, এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গির পিছনের কারণগুলো আমাদেরকে গভীরভাবে চিন্তিত করে তুলতে পারে। এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হওয়া সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামো সম্পর্কে আমাদেরকে মূল্যবান শিক্ষাগুলো দিতে পারে।

প্রথম ঘটনা: রাতে কুরআন তিলাওয়াত শোনা

প্রথম ঘটনাটি সীরাত ইবনু হিশাম থেকে পাওয়া যায়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) রাতে নিজের ঘরে সালাত আদায় করতেন, তখন তার কুরআন তিলাওয়াত শুনতে আসতো কুরাইশের কিছু নেতা। এদের মধ্যে ছিলেন আবু সুফিয়ান, আখনাস আস-সাকাফী এবং আবু জাহল। তারা রাতে গোপনে এসে রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর তিলাওয়াত শুনত এবং ভোরবেলা বাড়ি ফিরতো। তবে প্রত্যেক বারই তারা একে অপরের সামনে ধরা পড়ে যেত এবং এই নিয়ে বিব্রত হতো। এই ঘটনাটি একটানা তিন দিন চলতে থাকে।

এরপর আখনাস একে একে আবু সুফিয়ান এবং আবু জাহলের কাছে গিয়ে তাদের মতামত জানতে চান। আবু সুফিয়ান যদিও সরাসরি কোনো উত্তর দেননি, তবে আবু জাহলের প্রতিক্রিয়া ছিল অসাধারণ। তিনি জানিয়েছেন, যে তাদের গোত্র বানূ আব্দমানাফ এবং বানূ মাখযুমের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব নিয়ে প্রতিযোগিতা ছিল এবং সেই প্রতিযোগিতায় নবী হওয়ার দাবি তাদের জন্য এক বিপদ হিসেবে ধরা পড়ে। তিনি বলেছিলেন যে মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে নবী হিসেবে মেনে নিলে তাদের গোত্রের মর্যাদা হারাবে। এই চিন্তাধারা তাদের জন্য ছিল সবচেয়ে বড় বাধা এবং সেই কারণে তারা সত্যকে অস্বীকার করেছিল।

দ্বিতীয় ঘটনা: রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে মোলাকাত

দ্বিতীয় ঘটনাটি বর্ণনা করেছেন সাহাবী মুগীরাহ ইবনু শুবা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)। তিনি উল্লেখ করেছেন, যে একদিন আবু জাহল ও তিনি মক্কার একটি গলি দিয়ে হাঁটছিলেন, তখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর সাথে তাদের সাক্ষাৎ হয়। রাসূলুল্লাহ (ﷺ) আবু জাহলকে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের দিকে আহ্বান জানান। আবু জাহল উত্তর দেন, মুহাম্মাদ (ﷺ)-কে উদ্দেশ্য করে, যে তিনি তার ইলাহদের নিন্দা করা বন্ধ না করলে তিনি কখনোই তার দাওয়াহ গ্রহণ করবেন না। তবে তিনি এও স্বীকার করেন যে, যদি মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর কথা সত্য হত তবে তিনি তা গ্রহণ করতেন। কিন্তু তার নিজের বক্তব্যেই পরিষ্কার যে, তার নিজস্ব ক্ষমতা ও মর্যাদা হারানোর ভয় তাকে সত্যকে গ্রহণ করতে বাঁধা দেয়।

সত্য জেনেও প্রত্যাখ্যান: আল-মালা'র ভূমিকা

এই দুটি ঘটনা ইসলামের প্রচারের প্রথম যুগে কুরাইশদের মধ্যে যারা নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর বিরোধিতা করেছিল তাদের মানসিকতা এবং চিন্তাধারা সম্পর্কে আমাদের একটি স্পষ্ট চিত্র প্রদান করে। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে যাদের আল-মালা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে, অর্থাৎ সমাজের নেতা বা এলিটরা, তারা নবীদের বিরোধিতায় সবচেয়ে বেশি সক্রিয় ছিল। তারা বুঝত যে নবীদের দাওয়াহ তাদের গড়ে তোলা আধিপত্যের কাঠামোর জন্য একটি হুমকি।

গোত্রগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং ক্ষমতার লোভ

আবু জাহলের মতন সমাজের অনেক ক্ষমতাশালী ব্যক্তি সত্যকে চিনতে পেরেছিল, তবে তাদের নিজস্ব ক্ষমতা, মর্যাদা, এবং গোত্রগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা তাদের সেই সত্য গ্রহণ করতে দেয়নি। আবু জাহলের চিন্তাধারা এবং তার কথাগুলো থেকে স্পষ্ট যে, তার নিজের গোত্রের স্বার্থ তাকে নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সত্যকে মেনে নিতে বাধা দেয়। তিনি জানতেন যে, মুহাম্মাদ (ﷺ) সত্য বলছেন, কিন্তু গোত্রের ক্ষমতা হারানোর ভয়ে তিনি সেই সত্যকে অস্বীকার করেন।

সামাজিক-রাজনৈতিক হিসেবনিকেশের অস্থায়িত্ব

আবু জাহল যে চিন্তা করেছিল সেই হিসেবনিকেশ মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে সেকেলে হয়ে যায়। ইসলাম ধীরে ধীরে মক্কার সীমা ছাড়িয়ে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ইসলাম গ্রহণকারী সাহাবীগণ যেমন আবু বকর, উমার, উসমান, আলী (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) অল্প সময়ের মধ্যেই বৃহত্তর ভূমির শাসক হন এবং বিশ্বজুড়ে মর্যাদা ও নেতৃত্ব লাভ করেন। অথচ আবু জাহল গোত্রগত ক্ষমতার লোভের কারণে নিজেকে সেই সম্মান ও মর্যাদার অংশীদার বানাতে ব্যর্থ হন এবং একই সাথে আখিরাতেও জান্নাত থেকে বঞ্চিত হন।

প্যারাডাইম শিফট এবং ইসলামের শক্তি

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) যে দাওয়াহ নিয়ে এসেছিলেন তা মূলত একটি প্যারাডাইম শিফটের ইঙ্গিত বহন করে। সমাজ ও রাজনীতির যে কাঠামো সেই সময়ের মধ্যে ছিল তা নতুন ইসলামী প্যারাডাইমের প্রেক্ষিতে পুরনো হয়ে পড়ে। ইসলাম এমন একটি কাঠামো প্রবর্তন করেছিল যার মূল ভিত্তি ছিল আল্লাহর তাওহীদ এবং নবী মুহাম্মাদ (ﷺ)-এর সুন্নাহ। এই নতুন কাঠামো পূর্বের রাজনৈতিক হিসেবনিকেশকে অপ্রাসঙ্গিক করে তোলে এবং মুসলিমদের বিশ্বব্যাপী নেতৃত্ব লাভের পথ প্রশস্ত করে।

শিক্ষণীয় বিষয়: সত্যের প্রতি স্থিরতা

আবু জাহলের জীবনী থেকে যে মূল শিক্ষাটি আমরা পাই তা হল, ক্ষমতা, মর্যাদা এবং সামাজিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা মানুষের মনকে অন্ধ করতে পারে। সত্যকে চিনে গ্রহণ করতে অক্ষম করে তুলতে পারে। তবে ইসলামের শিক্ষা হল যে, সত্যের প্রতি স্থির থাকা এবং আল্লাহর প্রতি নির্ভর করা। যে ব্যক্তি সত্যকে গ্রহণ করে এবং আল্লাহর প্রতি পরিপূর্ণ আস্থা রাখে, তিনি দুনিয়া এবং আখিরাত উভয় ক্ষেত্রেই সফল হন।

ইসলামের বাস্তবিকতা ও যুগের পরিবর্তন

আবু জাহল এবং তার মতন ব্যক্তিরা ইসলামের বিরুদ্ধে যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল তা তাদের সময়ের জন্য যৌক্তিক মনে হতে পারে, কিন্তু ইসলামের বাস্তবিকতা তাদের সকল পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে দেয়। ইসলাম শুধুমাত্র একটি ধর্ম নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা যা যে কোনো সময় এবং পরিবেশে প্রযোজ্য। অতএব, সত্যকে গ্রহণ করা এবং আল্লাহর প্রতি নির্ভর করা—এই শিক্ষাই আমাদের বর্তমান সময়েও প্রাসঙ্গিক। এই ব্লগে আমরা দেখলাম কিভাবে আবু জাহলের মত একজন ক্ষমতাবান ব্যক্তি নিজের সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থানের জন্য ইসলামের সত্যকে অস্বীকার করেছিলেন। 

Thanks For Comment we are reply soon as possible.

Previous Post Next Post