ইসলামে বিবর্তনবাদ গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে আলোচনা

বিবর্তনবাদের আলোচনা, বিশেষত মানুষের সৃষ্টির ব্যাপারে, মুসলিম সমাজে দীর্ঘদিন ধরে বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। অনেক মুসলিম স্কলার, বিশেষত পশ্চিমা দা’ঈ এবং অ্যাকাডেমিকরা, এমন একটি অবস্থান গ্রহণ করেছেন যা বিবর্তনবাদের সাথে কিছুটা আপোস করে। এ অবস্থানটি হল: “মানুষ ছাড়া অন্য সব প্রাণীর ক্ষেত্রে বিবর্তনবাদের বক্তব্য মুসলিম হিসেবে আমরা মেনে নিতে পারি। এতে করে কুরআনের সাথে কোন আপাত সংঘর্ষ দেখা দেয় না। তবে মানুষ আল্লাহর বিশেষ সৃষ্টি যা বিবর্তনবাদের মাধ্যমে আসেনি।”

এমন অবস্থান গ্রহণ করার পেছনে মূলত দুটি কারণ রয়েছে:

১. আধুনিক বিজ্ঞান ও ইসলামের সংঘাত কমানো: মুসলিমরা বিশ্বাস করেন যে বিজ্ঞান এবং ইসলাম একে অপরের পরিপূরক। অতএব, এমন একটি অবস্থান গ্রহণ করা হয় যেখানে আধুনিক বিজ্ঞানকে সঠিক বিবেচনা করে এবং একই সঙ্গে কুরআনের বর্ণনার সাথে সাংঘর্ষিক না হয়ে।

২. নাস্তিকদের সাথে তর্ক কমানো: অনেকেই মনে করেন যে বিবর্তনবাদ গ্রহণ করলে নাস্তিকদের সাথে সংঘর্ষ কমে আসবে এবং মুসলিমদের বিশ্বাসকে আরো মজবুত করা যাবে।

যদিও এ ধরনের অবস্থান গ্রহণের পেছনে যৌক্তিক কারণ থাকতে পারে, এটি আদতে ইসলামের অবস্থানকে দুর্বল করে তোলে। কেননা, এই ধরনের চিন্তাধারা মূলত ইসলামকে বিজ্ঞানবাদের (scientism) অধীনস্ত করে তোলে এবং এভাবে ইসলামের ঐতিহ্যগত জ্ঞানতত্ত্বকে (epistemology) অবমাননা করা হয়।

ওয়ার্ল্ডভিউ এবং ইসলামের জ্ঞানতত্ত্ব (Epistemology)

বিবর্তনবাদের আলোচনার মূল বিষয় হল মানুষ এবং প্রাণের উৎস। প্রাণ কী? মানুষ কী? এ প্রশ্নগুলো কেবলমাত্র নির্দিষ্ট কিছু বিশ্বাস এবং দৃষ্টিভঙ্গির মাধ্যমে বিশ্লেষণ করা যায়। যে কেউ যখন এই প্রশ্নগুলোর উত্তর দেয়, তখন তারা নির্দিষ্ট কিছু অন্টোলজিক্যাল (ontology) এবং এপিস্টেমোলজিক্যাল (epistemology) পূর্বধারণা গ্রহণ করে থাকেন।

অন্টোলজি এবং ইসলাম

অন্টোলজি (বাংলায় পরাবিদ্যা বা তত্ত্ববিদ্যা) বাস্তবতার প্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করে। ইসলাম অনুযায়ী, রূহ, মালাইকা, জ্বিন, বারযাখ, জান্নাত-জাহান্নাম এবং আরও অনেক কিছু বাস্তব। কিন্তু আধুনিক বিজ্ঞান তথা সায়েন্টিফিক ম্যাটেরিয়ালিসম এসব কিছুকে অস্বীকার করে। অতএব, যখন একজন মুসলিম বিবর্তনবাদ মেনে নেন, তখন তাকে এই বাস্তবতার অনেকগুলো দিককে বাতিল করতে হয়।

এপিস্টেমোলজি এবং ইসলাম

এপিস্টেমোলজি (বাংলায় জ্ঞানতত্ত্ব) আলোচনা করে জ্ঞান, মানবীয় জ্ঞানের প্রকৃতি, উৎস ও সীমানা নিয়ে। ইসলাম যুক্তি, চিন্তা এবং বিজ্ঞানকে জ্ঞানের উৎস হিসেবে স্বীকৃতি দিলেও, চূড়ান্ত এবং সুনিশ্চিত জ্ঞানের উৎস হিসেবে শুধুমাত্র ওহি বা আল্লাহর বাণীকে গ্রহণ করে। অন্যদিকে, বিজ্ঞানবাদ (scientific materialism) ওহিকে অস্বীকার করে।

এখানে বিবর্তনবাদ এবং ইসলামের মধ্যে সংঘর্ষের স্পষ্ট একটি দৃষ্টান্ত দেখা যায়। বিজ্ঞান যেহেতু ওহির ভিত্তিকে অস্বীকার করে, সুতরাং বিজ্ঞানকে চূড়ান্ত জ্ঞানের উৎস হিসেবে গ্রহণ করলে মুসলিমদের বিশ্বাস সংকটে পড়ে।

বিবর্তনবাদ এবং তার প্রভাব

বিবর্তনবাদের আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে হলে, একজনকে কোনো না কোনো নির্দিষ্ট অন্টোলজিক্যাল এবং এপিস্টেমোলজিক্যাল অবস্থান গ্রহণ করতে হবে। বিবর্তনবাদ সায়েন্টিফিক ম্যাটেরিয়ালিসম এবং এম্পিরিসিজমকে (empiricism) ভিত্তি করে, যা তাওহিদ, রিসালাত এবং ওহিকে নাকচ করে কিংবা অপ্রাসঙ্গিক সাব্যস্ত করে।

এছাড়াও, বিবর্তনবাদ গ্রহণ করলে মানুষের অস্তিত্বের উদ্দেশ্য ও গন্তব্য (teleology) সম্পর্কে কিছু নির্দিষ্ট অনুসিদ্ধান্ত ও উপসংহার চলে আসে। প্রাণ যদি এলোমেলো প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ার অংশ হয়, তাহলে নিশ্চয় প্রাণের কোন উচ্চতর উদ্দেশ্য কিংবা গভীর অর্থ থাকতে পারে না। প্রাণ কেবল একটা ব্রুট ফ্যাক্ট। মহাজাগতিক দুর্ঘটনায় এই নীল পাথরের টুকরোতে কিছু প্রাণের উৎপত্তি হয়েছে। ব্যস! এর আর কোন তাৎপর্য নেই। মাহাত্ম্য নেই। একইভাবে নৈতিকতারও বিশেষ কোন গুরুত্ব নেই।

বিবর্তনবাদ: আংশিক গ্রহণ করার বিপদ

বিবর্তনবাদকে আংশিকভাবে গ্রহণ করা, যেমন- মানুষ ছাড়া অন্য সব প্রাণীর ব্যাপারে বিবর্তনবাদের বক্তব্য মেনে নেওয়া, ইসলামের মূল অবস্থানকে দুর্বল করে। এ অবস্থান গ্রহণ করা মানে সায়েন্টিফিক ম্যাটেরিয়ালিসমের অনেকগুলো পূর্বধারণাকে গ্রহণ করা, যা একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।

বিবর্তনবাদ একটি সামগ্রিক বিশ্বদর্শন (worldview) যা জীবনের উৎপত্তি, মানুষের উদ্দেশ্য এবং নৈতিকতার ব্যাপারে স্পষ্ট এবং নির্দিষ্ট অবস্থান নেয়। যদি কেউ বিবর্তনবাদকে আংশিকভাবে গ্রহণ করে, তবে তাকে পুরো বিবর্তনবাদী দৃষ্টিভঙ্গিও মেনে নিতে হয়, যা ইসলামের সাথে স্পষ্টভাবে সাংঘর্ষিক। উদাহরণস্বরূপ, ইয়াক্বীন ইনস্টিটিউটের একটি গবেষণাপত্রে বলা হয়েছে যে, হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির মধ্যে এমন অংশ থাকতে পারে যারা বনী-আদম না এবং তাদের উদ্ভব অন্য কোন বানরজাতীয় প্রাণী থেকে হয়েছে।

ইসলাম এবং বিবর্তনবাদ: দ্বৈততা

বিবর্তনবাদকে আংশিকভাবে গ্রহণ করার আরেকটি সমস্যা হল, এই অবস্থান দীর্ঘমেয়াদে টেকসই নয়। যদি মানুষ ছাড়া অন্য সব প্রাণীর ক্ষেত্রে বিবর্তনবাদ মেনে নেওয়া হয়, তবে মানুষের ক্ষেত্রেও এর প্রয়োগ করতে হবে। বিজ্ঞান অনুযায়ী, বিবর্তন একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া, যা মানুষসহ সব প্রাণীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। সুতরাং, একজন মুসলিম যদি বিবর্তনবাদকে আংশিকভাবে গ্রহণ করে, তবে তাকে পুরোপুরি গ্রহণ করতেই হবে, যা ইসলামের মৌলিক বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক।

এছাড়াও, আধুনিক বিজ্ঞান ও বিবর্তনবাদ এখনো তার সব মৌলিক দাবি অকাট্যভাবে প্রমাণ করতে পারেনি। প্যান্সপারমিয়া (panspermia) এবং ইন্টেলিজেন্ট ডিসাইন (intelligent design) এর মতো বিভিন্ন তত্ত্ব এখনো আলোচনায় রয়েছে। যদি কেউ মুসলিম হিসেবে কুরআনের সাথে সংঘর্ষ না দেখে আংশিকভাবে বিবর্তনবাদ মেনে নিতে পারে, তবে কেন প্যান্সপারমিয়া অথবা ইন্টেলিজেন্ট ডিসাইন মেনে নেবে না?

ইসলাম এবং বিজ্ঞান সমানতালে থাকতে পারে, তবে এটি হতে হবে ইসলামের মূল বিশ্বাস এবং শিক্ষার সাথে সামঞ্জস্য রেখে। ইসলাম অনুযায়ী, আল্লাহ হলেন সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং নিয়ন্ত্রক। সুতরাং, বিজ্ঞান ও বিবর্তনবাদের আলোচনায় ইসলামকে বিজ্ঞানবাদের অধীনস্ত করার পরিবর্তে, ইসলামের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিকে বজায় রাখতে হবে। মুসলিমদের উচিত তাদের বিশ্বাস এবং জ্ঞানতত্ত্বের উপর ভিত্তি করে বিজ্ঞানকে মূল্যায়ন করা, এবং বিবর্তনবাদকে আংশিকভাবে গ্রহণ করা মানে ইসলামের জ্ঞানতত্ত্ব এবং বিশ্বাসকে দুর্বল করা।

বিবর্তনবাদ এবং ইসলাম উভয়ই একটি সামগ্রিক বিশ্বদর্শন প্রদান করে, যা একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক। অতএব, একজন মুসলিম হিসেবে বিজ্ঞান এবং ইসলামের মধ্যে সামঞ্জস্য বজায় রাখতে হবে, তবে তা কখনই ইসলামের মূল বিশ্বাসকে ত্যাগ করে নয়। বিবর্তনবাদের মতো জটিল এবং গভীর বিষয়গুলো আলোচনা করতে হলে, আমাদের ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি বজায় রেখে বিষয়টি বিচার করা উচিত।


Thanks For Comment we are reply soon as possible.

Previous Post Next Post