ইসলামে হাদিসের গুরুত্ব অপরিসীম। পবিত্র কুরআন মুসলিমদের কাছে আল্লাহর বাণী হিসেবে স্বীকৃত হলেও রাসূলুল্লাহ ﷺ এর জীবন ও কর্মকাণ্ড, যা আমরা হাদিস হিসেবে জানি, সেই নির্দেশনার ভিত্তিতে আমরা কুরআনকে সঠিকভাবে বুঝতে পারি। ইসলামের প্রথম যুগ থেকেই হাদিস শাস্ত্রের প্রণয়ন এবং সংরক্ষণ শুরু হয়েছিল। তবে, বর্তমান যুগে কিছু মানুষ এবং গোষ্ঠী হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। এদের মধ্যে কিছু দল সম্পূর্ণভাবে হাদিস অস্বীকার করে, আবার কেউ কেউ শুধুমাত্র কিছু হাদিসকে গ্রহণযোগ্য মনে করে, যা তাদের নিজস্ব মতামত এবং চিন্তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ।
হাদিস অস্বীকারকারীদের যুক্তি এবং তাদের ভুল
১. সহিহ ও জাল হাদিসের মাঝে পার্থক্য করা অসম্ভব: অনেক হাদিস অস্বীকারকারী দাবি করে যে, সহিহ ও জাল হাদিসের মধ্যে পার্থক্য করা অসম্ভব। তারা মনে করে, হাদিস শাস্ত্রের পদ্ধতিগত সমস্যা রয়েছে, যা নিশ্চিতভাবে সহিহ হাদিস চিহ্নিত করা কঠিন করে তোলে। তবে, এই দাবির পেছনে তাদের হাদিস শাস্ত্রের গভীর জ্ঞানহীনতা এবং এই শাস্ত্রের সঠিক মূল্যায়নে ব্যর্থতা কাজ করে।
২. পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসিনদের ইজমা গ্রহণ না করা: হাদিস অস্বীকারকারীরা পূর্ববর্তী মুহাদ্দিসিনদের ইজমা, অর্থাৎ সর্বসম্মত মতামতকে গ্রহণ করতে চায় না। তারা মনে করে, ইমাম আন-নাওয়াউয়ি রাহিমাহুল্লাহর মতো ইসলামের প্রখ্যাত আলেমগণ কেবল নিজেদের মতামতই প্রকাশ করেছেন, যা পরিবর্তনীয় হতে পারে।
৩. কুরআনের ব্যাখ্যায় নতুন দৃষ্টিভঙ্গি: হাদিস অস্বীকারকারীরা দাবি করে, কুরআনকে বুঝতে হলে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি এবং সমসাময়িক চিন্তাভাবনার সাথে তাল মিলিয়ে এর ব্যাখ্যা করা উচিত। তারা মনে করে, সালাফ আস-সালেহিনের মতামত এবং কুরআনের ব্যাখ্যা আজকের যুগের জন্য অপর্যাপ্ত।
৪. নতুন সামাজিক ও ধর্মীয় কাঠামোর প্রবর্তন: হাদিস অস্বীকারকারীরা মুসলিম সমাজের জন্য নতুন সামাজিক ও ধর্মীয় কাঠামোর প্রবর্তন করতে চায়। তারা মনে করে, ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক ব্যাখ্যা এবং দৃষ্টিভঙ্গি গ্রহণ করে একটি ইসলামি রেনেসার শুরু করা উচিত।
ইসলামের প্রকৃত অবস্থান
ইসলামের প্রকৃত অবস্থান হলো কুরআন ও হাদিস উভয়কেই গ্রহণ করা। কুরআন আমাদের প্রধান ধর্মগ্রন্থ হলেও, হাদিস রাসূলুল্লাহ ﷺ এর জীবন ও শিক্ষার প্রতিফলন। কুরআন এবং হাদিস একসাথে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে। কুরআনের আয়াতের প্রকৃত অর্থ এবং তাৎপর্য বুঝতে হাদিসের প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’আলা বলেন:
“অতীতের রসূলদেরকে পাঠিয়েছিলাম স্পষ্ট প্রমাণাদি আর কিতাব দিয়ে; আর এখন তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করছি মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছে আর যাতে তারা চিন্তা-ভাবনা করে।” [সূরা আন-নাহল, ৪৪]
এই আয়াত থেকে স্পষ্ট যে, কুরআনকে সঠিকভাবে বুঝতে হলে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর ব্যাখ্যা ও নির্দেশনার প্রয়োজন। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর হাদিস কেবলমাত্র তাঁর জীবন-চরিত নয়, বরং তা কুরআনের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা।
হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সমসাময়িক বিতর্ক
বিগত কিছু বছর ধরে হাদিসের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সমসাময়িক বিতর্ক দেখা যাচ্ছে। পশ্চিমা আদর্শ এবং দৃষ্টিভঙ্গির সাথে তাল মিলিয়ে কিছু মুসলিম চিন্তাবিদ হাদিসের গুরুত্ব এবং প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তারা মনে করে, ইসলামের মূল উৎস হিসেবে কেবলমাত্র কুরআনই যথেষ্ট এবং হাদিসকে গৌণ উৎস হিসেবে বিবেচনা করা উচিত।
তবে, এই ধারণা ইসলামের মূল আদর্শের সাথে সাংঘর্ষিক। ইসলামের প্রথম যুগ থেকে সাহাবীদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ ﷺ এর কথা এবং কাজের গুরুত্ব অপরিসীম ছিল। সাহাবীরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর প্রতিটি কথা এবং কাজ অনুসরণ করতেন এবং সেই ভিত্তিতে কুরআনকে বুঝতেন। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নির্দেশনা ব্যতীত কুরআনকে সঠিকভাবে বোঝা অসম্ভব।
সাহাবীদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং ইসলামের প্রকৃত অবস্থান
সাহাবীরা রাসূলুল্লাহ ﷺ এর উপস্থিতিতে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতেন না এবং তাঁর নির্দেশনার বিরোধিতা করতেন না। রাসূলুল্লাহ ﷺ এর নির্দেশনা এবং শিক্ষার প্রতি তাদের পূর্ণ আনুগত্য ছিল। ইসলামের প্রকৃত অবস্থান হলো কুরআন এবং হাদিস উভয়কে সমানভাবে গ্রহণ করা এবং সেই ভিত্তিতে দ্বীনের ব্যাখ্যা প্রদান করা।
হাদিস অস্বীকারকারীদের যুক্তি এবং তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের প্রকৃত শিক্ষার সাথে সাংঘর্ষিক। ইসলামের মূল শিক্ষা হলো কুরআন এবং হাদিস উভয়কে গ্রহণ করা এবং সেই ভিত্তিতে জীবন পরিচালনা করা। কুরআন এবং হাদিস একসাথে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি প্রদান করে এবং মুসলিমদের সঠিক পথ প্রদর্শন করে।
হাদিস অস্বীকারকারীদের প্রচলিত মতবিরোধ এবং ইসলামের প্রকৃত অবস্থান সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি করা জরুরি, যাতে মুসলিম উম্মাহ হাদিসের প্রকৃত গুরুত্ব বুঝতে পারে এবং সঠিক পথে চলতে পারে। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষাকে রক্ষা করার জন্য কুরআন এবং হাদিস উভয়কেই সঠিকভাবে অনুসরণ করা আমাদের অবশ্য কর্তব্য।