বাংলাদেশে মুসলিমদের দ্বীন ও আত্মপরিচয় রক্ষার জন্য সাংস্কৃতিক যুদ্ধ: একটি বিশ্লেষণ

বাংলাদেশের মুসলিমদের দ্বীন এবং আত্মপরিচয় রক্ষার জন্য বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনা করা যেতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ে, বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিমদের উপর আক্রমণ এবং এ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ ধারণার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। এই প্রবন্ধে আমরা তিনটি মূল ধারণার উপর ভিত্তি করে আলোচনা করব: সামাজিক আধিপত্য (Cultural Hegemony), সাংস্কৃতিক যুদ্ধ (Kulturkampf), এবং মেটাপলিটিকস। এই ধারণাগুলোর মাধ্যমে বাংলাদেশে ইসলামবিরোধী সেক্যুলার-প্রগতিশীল এলিটদের নিয়ন্ত্রণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার পথ খোঁজা হবে।

১. সামাজিক আধিপত্য (Cultural Hegemony)

সামাজিক আধিপত্য বা কালচারাল হেজেমনি বলতে বোঝায়, একটি নির্দিষ্ট গ্রুপ বা এলিট শ্রেণির পক্ষ থেকে সমাজের উপর এক ধরনের মানসিক এবং সাংস্কৃতিক আধিপত্য আরোপ করা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, সেক্যুলার-প্রগতিশীল এলিটরা ইসলাম ও মুসলিমদের উপর এই আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করছে। এদের মধ্যে অনেকেই মুসলিম নামধারী হলেও, তারা মূলত সেক্যুলার মূল্যবোধ এবং পশ্চিমা চেতনার অনুসারী। তারা তাদের প্রভাব এবং ক্ষমতা ব্যবহার করে সমাজের উপর তাদের ধারণা এবং আদর্শ চাপিয়ে দেয়।

এই ধরনের সামাজিক আধিপত্য ভাঙার জন্য প্রথমেই আমাদের নিজেদের দুর্বলতাগুলোকে চিনতে হবে এবং সেগুলো মোকাবেলার জন্য পরিকল্পনা করতে হবে। ইসলামবিরোধী সেক্যুলারদের এই আধিপত্য ভাঙার জন্য আমাদের সাংস্কৃতিক যুদ্ধের পথে অগ্রসর হতে হবে।

২. সাংস্কৃতিক যুদ্ধ (Kulturkampf)

সাংস্কৃতিক যুদ্ধ বা Kulturkampf বলতে বোঝায়, একটি সমাজে বিদ্যমান সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের মধ্যে সংঘাত। এই যুদ্ধের মূল উদ্দেশ্য হলো, সমাজের জনগণকে তাদের প্রথাগত মূল্যবোধ থেকে বিচ্যুত করা এবং নতুন একটি মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করা। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, সাংস্কৃতিক যুদ্ধ হলো সেক্যুলার এবং প্রগতিশীল মূল্যবোধের বিরুদ্ধে ইসলামী মূল্যবোধ রক্ষার জন্য একটি সংগ্রাম।

সাংস্কৃতিক যুদ্ধ পরিচালনা করতে হলে আমাদের মেটাপলিটিকাল সংগ্রামের আদলে কাজ করতে হবে। মেটাপলিটিকস হলো, মানুষের চিন্তায় ‘গ্রহণযোগ্য রাজনীতির’ যে সীমানা আছে, সেটাকে প্রসারিত করা এবং মানুষের মধ্যে ইসলামের প্রতি সচেতনতা বৃদ্ধি করা। এভাবে, সমাজের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশের চিন্তার ধরন এবং বিশ্বদৃষ্টি পাল্টে দেওয়া সম্ভব হবে।

৩. মেটাপলিটিকস

মেটাপলিটিকস একটি গুরুত্বপূর্ণ ধারণা যা সাংস্কৃতিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এটি মূলত সমাজের মানুষের চিন্তা-চেতনার উপর প্রভাব বিস্তার করে রাজনৈতিক এবং সামাজিক পরিবর্তন আনার একটি কৌশল। মেটাপলিটিকাল সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা আমাদের আদর্শ এবং মূল্যবোধকে সমাজের মূলধারায় প্রতিষ্ঠা করতে পারি।

মেটাপলিটিকাল সংগ্রামের কিছু কৌশল:

  1. ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রচারণা: বাংলাদেশে ইসলাম ও মুসলিমরা আক্রান্ত হচ্ছে—এই বাস্তবতা মানুষের মধ্যে গেঁথে দিতে হবে। ইসলামবিদ্বেষের উৎস, কারণ এবং এর ধারক-বাহকদের চিহ্নিত করে প্রমাণসহ তুলে ধরতে হবে।

  2. আত্মপরিচয়ের বয়ান তৈরি: বাংলার মুসলিমদের আত্মপরিচয়ের একটি সুস্পষ্ট বয়ান তৈরি করতে হবে, যেখানে ইসলামী শরীয়াহ হবে মাপকাঠি। বাঙালি সংস্কৃতি প্রমাণের জন্য ইসলামী আদর্শের সাথে আপস করা যাবে না।

  3. ইতিহাসের বয়ান তৈরি: বাংলাদেশের ইতিহাসের সঠিক এবং ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ বয়ান তৈরি করতে হবে। যেমন, ১৯৪৭, ১৯৭১, এবং ২০১৩ এর ঐতিহাসিক ঘটনাগুলোর ব্যাখ্যা করতে হবে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে।

  4. মূর্তি ভাঙা: সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের প্রচারিত ধারণাগুলোর বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অবস্থান নিতে হবে এবং তাদের সামাজিক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে।

  5. সামাজিক ইস্যুকে কাজে লাগানো: বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুকে ব্যবহার করে ইসলামবিদ্বেষ এবং সেক্যুলার ব্যবস্থার সমালোচনা করতে হবে এবং ইসলামী সমাধানের আলাপ আনতে হবে।

ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রচারণা

ইসলামবিদ্বেষের বিরুদ্ধে প্রচারণা পরিচালনা করতে হলে, একাডেমিক আলোচনা, বাস্তব উদাহরণ, এবং ক্রমাগত প্রচারণা এই তিনটি বিষয়ে জোর দিতে হবে। একাডেমিক আলোচনার মাধ্যমে শিল্প, সাহিত্য, কবিতা, সিনেমা, সংবাদ, এবং সুশীলতার নামে প্রচারিত ইসলামবিদ্বেষকে প্রমাণসহ তুলে ধরতে হবে। এর সাথে সাথে, বাস্তব উদাহরণ ও ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলে ধরে ইসলামবিদ্বেষের বাস্তব চিত্র প্রদর্শন করতে হবে।

ক্রমাগত প্রচারণার মাধ্যমে: সমাজের সকল স্তরে এই বার্তা পৌঁছে দেওয়া জরুরি। এই প্রচারণার মাধ্যমে ইসলামের বিরুদ্ধে বিদ্বেষের মূল চালিকাশক্তি কারা এবং কিভাবে তারা ইসলামবিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করছে তা স্পষ্ট করা হবে।

আত্মপরিচয়ের বয়ান তৈরি

বাংলার মুসলিমদের আত্মপরিচয়ের একটি বয়ান তৈরি করা প্রয়োজন যেখানে ইসলামী শরীয়াহ হবে মাপকাঠি। বাংলার মুসলিমরা সেক্যুলারদের মতাদর্শের অনুসরণ না করে তাদের ইসলামী আদর্শে দৃঢ় থাকবেন। শাহী বাংলার (সুলতানী আমলের বাংলা) ইসলামের বিজয়ের ইতিহাস, শহীদ তিতুমীর, হাজী শরীয়াতুল্লাহ, এবং ইমাম সাইয়্যিদ আহমাদ শহীদ এর দৃষ্টান্ত থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে।

ইতিহাসের বয়ান তৈরি

বাংলাদেশের ঐতিহাসিক সময়গুলোর (যেমন, ১৯৪৭, ১৯৭১, এবং ২০১৩) ব্যাপারে একটি সঠিক ন্যারেটিভ তৈরি করতে হবে যা ঐতিহাসিকভাবে সঠিক হবে আবার দ্বীনের সাথে আপস করবে না। ঐতিহাসিক বয়ান তৈরি করতে গিয়ে আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে যেন সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের তৈরি করা বয়ানই মূলত গ্রহণ না করা হয়।

মূর্তি বিরুদ্ধে অবস্থান 

মূর্তি বিরুদ্ধে অবস্থান অর্থ হলো সেক্যুলার-প্রগতিশীলদের প্রচারিত ধারণাগুলোর বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অবস্থান নেওয়া এবং তাদের সামাজিক আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করা, কিন্তু ব্যক্তিগত রেষারেষিতে এই কাজগুলো করতে যাবেন না তাহলে আইনি মানদণ্ডে ভেসে যাবেন। যেমন, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র, নারীবাদ, প্রগতি, মানবাধিকার, এবং সেক্যুলার নৈতিকতার ধারণাগুলোকে খণ্ডন করা।

আক্রমণাত্মক সমালোচনা ও ব্যঙ্গবিদ্রুপ: সাংস্কৃতিক জমিদারদের প্রচলিত পবিত্র ব্যক্তি ও ধারণাগুলোকে আক্রমণ করতে হবে এবং সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ করতে হবে। চিন্তার সমালোচনা আর ব্যবচ্ছেদ, বিভিন্ন ব্যক্তি কিংবা ধারণার ব্যাপারে মানুষের মনে গড়ে ওঠা সমীহ ভেঙে ফেলা—সবই এর অংশ।

সামাজিক ইস্যুকে কাজে লাগানো

বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুকে ব্যবহার করে ইসলামবিদ্বেষ এবং বিদ্যমান সেক্যুলার ব্যবস্থার সমালোচনা করা যেতে পারে। প্রতিটি ইস্যুকে দেখাতে হবে একটি যুলুমপূর্ণ, কলুষিত ব্যবস্থার ফলাফল হিসেবে। যেমন, কোনো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক যদি ‘আসসালামু আলাইকুম’ বলাকে উগ্রবাদ হিসেবে তুলে ধরে, তাহলে আমাদের বার্তা হতে পারে, এটি নিছক একজন ব্যক্তির কথা নয়, বরং বাঙালি সংস্কৃতির নামে এমন এক ঘৃণাবাদী আদর্শ আমাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে।

প্রতিপক্ষের বয়ানের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করা

সাংস্কৃতিক যুদ্ধের ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষের বয়ানের গ্রহণযোগ্যতা নষ্ট করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ কৌশল। এর মাধ্যমে তাদের বক্তব্যের ভিত্তি দুর্বল করে দেওয়া যায়। সাংস্কৃতিক জমিদারদের বক্তব্য এবং অবস্থানগুলোকে ব্যঙ্গবিদ্রুপের মাধ্যমে হাস্যস্পদ করে তোলা এবং বিভিন্ন তুচ্ছার্থক শব্দ ও বিশেষণের প্রচলন ঘটানোর মাধ্যমেও হতে পারে। এর পাশাপাশি, মিম এবং ট্রোলিংয়ের মাধ্যমেও তাদের পাবলিক ডিসকোর্সকে শর্টসার্কিট করা সম্ভব।

বিকল্প মিডিয়া এবং সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার

বিকল্প মিডিয়া গড়ে তোলা সাংস্কৃতিক যুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সোশ্যাল প্ল্যাটফর্ম যেমন ইউটিউব, ফেসবুক, পডকাস্ট, ওয়েবিনার ইত্যাদি ব্যবহার করে আমাদের বক্তব্যকে ছড়িয়ে দেওয়া যেতে পারে। এভাবে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমকে ব্যবহার করে সাংস্কৃতিক যুদ্ধে অংশগ্রহণ করা যাবে।

Thanks For Comment we are reply soon as possible.

Previous Post Next Post