বাংলাদেশে এলজিবিটি (লেসবিয়ান, গে, বাইসেক্সুয়াল, ট্রান্সজেন্ডার) আন্দোলনের যাত্রা মূলত এইডস প্রতিরোধ এবং যৌন স্বাস্থ্য সেবার ব্যানারে শুরু হয়েছিল। ২০০৬/০৭ সালের দিকে এই আন্দোলনে একটি নতুন দিক আসে, যখন এটি যৌন অধিকার এবং যৌন সংখ্যালঘুদের অধিকারের দাবিতে রূপান্তরিত হতে শুরু করে। এই নতুন যুগের সূচনার পেছনে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথ।
যৌন অধিকার আন্দোলনের উত্থান
২০০৫ সালে ব্র্যাকের কিছু গবেষক যুক্তরাজ্যে এক গবেষণা কনসোর্টিয়ামে অংশগ্রহণের পর দেশে ফিরে যৌন অধিকার নিয়ে কাজ করতে আগ্রহী হন। যৌনতার আলোচনা এবং যৌন সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে জনপরিসরে আলাপ তৈরি করার জন্য ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ২০০৭ সাল থেকে মিটিং, ওয়ার্কশপ এবং মতবিনিময় সভার আয়োজন শুরু করে। এসব কার্যক্রমের মাধ্যমে তারা যৌন বৈচিত্র্যের বিষয়গুলোকে মানবাধিকারের কাঠামোতে উপস্থাপন করার চেষ্টা করে।
ব্র্যাকের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
ব্র্যাকের এই উদ্যোগগুলো এলজিবিটি আন্দোলনের প্রাথমিক পর্যায়ে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাদের ‘Creating A Public Space And Dialogue On Sexuality And Rights: A Case Study From Bangladesh’ নিবন্ধে বলা হয়েছে যে, ব্র্যাকের এই উদ্যোগগুলো যৌনতার ব্যাপারে সমাজের নীরবতা ভেঙে জনপরিসরে আলোচনা শুরু করতে সাহায্য করে। ব্র্যাকের এই উদ্যোগের ফলে নীতি নির্ধারক, সুশীল সমাজ এবং মিডিয়া পেশাজীবীদের মধ্যে যৌন অধিকারের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনার প্রেক্ষাপট তৈরি হয়।
কৌশলগত পদক্ষেপ
ব্র্যাকের এই উদ্যোগে আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল তাদের কৌশলগত পদক্ষেপ। তারা শুধুমাত্র যৌন সংখ্যালঘুদের নিয়ে কাজ করেনি, বরং অ্যাকাডেমিক এবং মিডিয়ার লোকজনকেও এলজিবিটির পক্ষে কথা বলতে উৎসাহিত করেছে। বিভিন্ন কর্মশালা এবং মিটিংয়ের মাধ্যমে ব্র্যাক তাদের মধ্যে যৌনতার উপস্থাপনা এবং যৌন বৈচিত্র্যের ধারণা প্রচার করে। এতে করে মিডিয়ায় এবং সমাজের অন্যান্য ক্ষেত্রে এলজিবিটি ইস্যুগুলোর একটি গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়।
যৌনতার সামাজিকীকরণ
ব্র্যাকের উদ্যোগে একটি বিশেষ বিষয় লক্ষ্যণীয় যে, তারা যৌনতার সামাজিকীকরণ এবং যৌন বিকৃতির সামাজিকীকরণের মধ্যে একটি সুক্ষ্ম পার্থক্য রেখেছে। তারা যৌন সংখ্যালঘুদের অধিকারকে সরাসরি সমকামীতা বা যৌন বিকৃতির বৈধতা হিসেবে প্রচার করেনি, বরং এটি ‘যৌন অধিকার’ এবং ‘যৌন বৈচিত্র্য’ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। এর মাধ্যমে তারা সমাজে যৌন বিকৃতির বৈধতা এবং সামাজিকীকরণের কাজটি অনেক দূর এগিয়ে নিয়েছে।
এলজিবিটি আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায়
ব্র্যাকের উদ্যোগের পর বাংলাদেশের এলজিবিটি আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায়ের সূচনা হয়। এই পর্যায়ে এলজিবিটি ইস্যুগুলোর উপর আরও খোলামেলা আলাপ-আলোচনা শুরু হয় এবং মিডিয়া, অ্যাকাডেমিক এবং নীতিনির্ধারকদের মধ্যে এলজিবিটি এজেন্ডার সমর্থনে কিছু মানুষ তৈরি হয়। এলজিবিটি সম্প্রদায়ের লোকেরা আরও সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং বিভিন্ন সংগঠন গঠন করে।
বাংলাদেশে এলজিবিটি আন্দোলনের যাত্রা মূলত এইডস প্রতিরোধ এবং যৌন স্বাস্থ্য সেবার ব্যানারে শুরু হয়েছিল, কিন্তু ব্র্যাকের উদ্যোগের মাধ্যমে এটি যৌন অধিকার আন্দোলনে রূপান্তরিত হয়। তাদের কৌশলগত পদক্ষেপ এবং কার্যক্রমের ফলে বাংলাদেশের সমাজে এলজিবিটি ইস্যুগুলো নিয়ে একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি হয়। এই আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায়ে এসে এটি আরও ব্যাপক এবং গভীরভাবে প্রতিষ্ঠিত হতে থাকে।
এই লেখাটি কেবলমাত্র বাংলাদেশের এলজিবিটি আন্দোলনের প্রেক্ষাপট এবং এর বিভিন্ন পর্যায়ের বিবরণ উপস্থাপন করেছে। ভবিষ্যতে এই আন্দোলন কিভাবে আরও প্রভাবশালী এবং বিস্তৃত হবে, তা নিয়ে আমরা আরও বিশদ আলোচনা করতে পারি।