ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক ইতিহাস এবং তাদের তথাকথিত সভ্যতার সঙ্কট

বিশ্ব ইতিহাসে ঔপনিবেশিক যুগের কথা বললে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর শোষণমূলক, বর্ণবাদী নীতি এবং তাদের লোভাতুর সাম্রাজ্যবাদী প্রবণতা সবচেয়ে বেশি আলোচিত হয়। ফ্রান্স, ব্রিটেন, স্পেন, পর্তুগালসহ একাধিক ইউরোপীয় শক্তি বিশ্বজুড়ে উপনিবেশ গড়ে তুলে সেই অঞ্চলের সম্পদ দখল করে নিয়েছে, স্থানীয় জনগণের জীবিকা ধ্বংস করেছে, আর বর্ণবৈষম্য ও সাংস্কৃতিক শোষণ চালিয়েছে। এর মধ্যে ফ্রান্স অন্যতম। আজকের আলোচনায় আমরা ফ্রান্সের তথাকথিত 'সভ্যতা' এবং এর পেছনে থাকা বাস্তবতাকে অন্বেষণ করবো। ফরাসি প্রাচ্যবাদের প্রকৃতি, এর ইতিহাস এবং সমসাময়িক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করবো, যা আজও তাদের রাজনৈতিক নীতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

ফরাসি 'সভ্যতা': ঔপনিবেশিক শাসনের আড়ালে শোষণ

ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক যুগে ফরাসি দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের "সভ্যতার প্রচারক" হিসেবে পরিচয় দিতেন। তারা দাবি করতেন, ইউরোপীয় সংস্কৃতি এবং মূল্যবোধ মানব সভ্যতার সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে, এবং এটি অন্য জাতিগুলির জন্য আদর্শ। এই দাবি বাস্তবে কতটা নৈতিক ছিল? সেটাই এখানে বিশ্লেষণের বিষয়।

ফরাসি দার্শনিকদের বর্ণবাদী দৃষ্টিভঙ্গি

ফরাসি দার্শনিক ও বুদ্ধিজীবীরা নিজেদের সময়ে আধুনিক দর্শনের প্রবক্তা হিসেবে নিজেদের গৌরবময় ইতিহাস তৈরি করতে সচেষ্ট ছিলেন। তবে সেই দর্শনের অভ্যন্তরে ছিল ভয়ানক বর্ণবাদী ও শ্রেষ্ঠত্ববাদী চিন্তা। যেমন ভলতেয়ার (মৃত্যু ১৭৭৮), যিনি "এনলাইটেনমেন্টের" প্রতীক বলে পরিচিত, কৃষ্ণাঙ্গদের মানবিক মর্যাদা সম্পর্কে অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। তার লেখায় তিনি আফ্রিকানদের পশুর সাথে তুলনা করেছেন এবং তাদের বুদ্ধির পরিমাণকে ইউরোপীয়দের তুলনায় নিম্নমানের বলে আখ্যায়িত করেছেন। ভলতেয়ারের মতামত শুধু তার ব্যক্তিগত দৃষ্টিভঙ্গিই নয়, বরং এটি তখনকার ঔপনিবেশিক যুগের ইউরোপীয় জাতির মধ্যে প্রভাবিত ধারণাগুলোকেই প্রতিফলিত করেছিল।

একইভাবে, ইমানুয়েল জোসেফ সিয়েইস, ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম তাত্ত্বিক, শ্রমিক শ্রেণীকে 'কাজের যন্ত্র' এবং 'দুপেয়ে যন্ত্র' হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। তার মতে, শ্রমিকরা নি¤œমানের মানুষ, যারা সমাজের শীর্ষস্থানীয়দের তুলনায় কম বুদ্ধিমান এবং কম মর্যাদাবান। এটি সেই যুগের ইউরোপীয় মানসিকতারই প্রতিফলন ছিল, যেখানে তারা নিজেদের শ্রেষ্ঠ হিসেবে তুলে ধরে অন্য জাতি ও সম্প্রদায়কে অবমূল্যায়ন করেছে।

আলজেরিয়ার গণহত্যা ও টকভিলের সমর্থন

এনলাইটেনমেন্ট এবং স্বাধীনতার দর্শনের আরেক প্রবক্তা, আলেক্সিস দ্য টকভিল, আলজেরিয়ার বিরুদ্ধে পরিচালিত ফরাসি ঔপনিবেশিক অভিযানের প্রবল সমর্থক ছিলেন। তার মতে, আলজেরিয়ানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ফসল ধ্বংস, গবাদিপশু লুট, এবং গ্রাম ধ্বংস করা নৈতিক ও প্রয়োজনীয় কাজ। তিনি বিশ্বাস করতেন, এটি ফরাসি জনগণের জন্য সঠিক পথ, যা তাদের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ। টকভিলের এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রমাণ করে যে, তথাকথিত সভ্য ইউরোপীয়রা কতটা নিষ্ঠুর ছিল এবং তারা তাদের অধিকার ও শ্রেষ্ঠত্ব রক্ষার্থে মানবিকতার প্রতি কতটা অবজ্ঞাশীল ছিল।

মানব চিড়িয়াখানা এবং ফ্রান্সের বর্ণবাদী মনোভাব

বিশ্ববাসীর চোখে ফ্রান্স আজও অনেকের কাছে মানবাধিকার ও স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে পরিচিত। তবে ফ্রান্সের ইতিহাসের একটি গাঢ় কালো অধ্যায় রয়েছে যা খুব কমই আলোচিত হয়। ১৯৩১ সাল পর্যন্ত ফ্রান্সে 'মানব চিড়িয়াখানা' নামে একটি নিষ্ঠুর প্রদর্শনী পরিচালিত হতো। এই প্রদর্শনীতে ঔপনিবেশিক দেশগুলো থেকে বন্দী করা মানুষদের জনসম্মুখে পশুর মতো দেখানো হতো। ফ্রান্সের এই অমানবিক আচরণ থেকে বোঝা যায়, তারা শুধুমাত্র তাদের অর্থনৈতিক ও সামরিক স্বার্থেই নয়, বরং তাদের সাংস্কৃতিক শ্রেষ্ঠত্বও প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল, যা প্রকৃতপক্ষে ছিল একটি বর্ণবাদী এবং শোষণমূলক ব্যবস্থা।

আলজেরিয়ার গণহত্যা: ১৯৪৫ সালের সিতিফ ও গুয়েলমা

ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক শাসনের সময় আলজেরিয়ায় যে নারকীয় গণহত্যা ঘটেছিল, তা ঔপনিবেশিক শাসনের শোষণ ও নির্যাতনের একটি চরম উদাহরণ। ১৯৪৫ সালের সিতিফ ও গুয়েলমা গণহত্যায়, ফরাসি সামরিক বাহিনী ও বসতি স্থাপনকারীরা হাজার হাজার আলজেরিয়ানকে হত্যা করেছিল। তাদের স্বাধীনতা এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষাকে নির্মমভাবে দমন করা হয়েছিল। ফরাসি সাম্রাজ্যবাদ এভাবে স্থানীয় জনগণের প্রতি সহিংসতা চালিয়ে তাদের শাসনকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করেছিল, যা আসলে ছিল একটি নৃশংস গণহত্যা।

সমসাময়িক ফরাসি রাজনীতি ও ইসলামবিদ্বেষ

এখনও ফ্রান্সে বর্ণবাদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। সাম্প্রতিক ফরাসি রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের মধ্যে বর্ণবাদী এবং ইসলামবিদ্বেষী মনোভাব প্রকাশ পেয়েছে। জ্যাক শিরাক, নিকোলা সারকোজি, এবং বর্তমান প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল ম্যাখোঁ—তিনজনই তাদের বিভিন্ন বক্তব্যে আফ্রিকা এবং মুসলিম জনগোষ্ঠীকে অবমাননা করেছেন। সারকোজি ২০০৭ সালে সেনেগালে তার বক্তব্যে বলেন, "আফ্রিকা এখনো পুরোপুরি ইতিহাসে প্রবেশ করতে পারেনি," যা স্পষ্টতই ফরাসি ঔপনিবেশিক মানসিকতার প্রতিফলন।

২০১৭ সালে প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ এক বক্তব্যে বলেন, আফ্রিকান নারীদের ৭-৮ জন করে সন্তান জন্ম দেয়ার কারণে আফ্রিকার উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। তার এই মন্তব্য প্রমাণ করে যে, আধুনিক ফ্রান্সের বর্ণবাদী এবং ঔপনিবেশিক চিন্তাভাবনা আজও বদলায়নি। ফ্রান্সে ইসলামবিদ্বেষী নীতিগুলি আজও বিদ্যমান, যেখানে মুসলিম জনগোষ্ঠীকে টার্গেট করে নানা রকম বৈষম্যমূলক আইন এবং প্রস্তাবনা আনা হয়।

ফ্রান্সের শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ব এবং দায়িত্বহীন নীতি

আজকের ফ্রান্স, বিশেষ করে এর রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক এলিটদের আচরণ ও বক্তব্য দেখে বোঝা যায় যে, তারা এখনো তাদের ঔপনিবেশিক অতীত এবং শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা থেকে বের হতে পারেনি। সাম্প্রতিক কালে ইসলামবিদ্বেষী এবং বর্ণবাদী প্রস্তাবনাগুলি পপুলিস্ট কৌশলের অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। এটি সেই ফরাসি রাজনীতির একটি বড় দিক, যা জনগণের মধ্যে বিদ্যমান বর্ণবাদী চিন্তাভাবনারই প্রতিফলন। প্রেসিডেন্ট ম্যাখোঁ এবং মারি লা পেনের মতো রাজনৈতিক নেতাদের জনপ্রিয়তা প্রমাণ করে যে, ফরাসি সমাজের একটি বড় অংশ এখনো শ্বেতাঙ্গ শ্রেষ্ঠত্ব এবং বর্ণবাদী চিন্তাভাবনার প্রতি আগ্রহী।

ফ্রান্সের ঔপনিবেশিক ইতিহাস, বর্ণবাদী মনোভাব, এবং তথাকথিত 'সভ্যতা' পৃথিবীর কাছে একটি বড় ধোঁকা ছিল। তারা নিজেদেরকে পৃথিবীর নেতৃস্থানীয় সভ্যতা হিসেবে উপস্থাপন করলেও, তাদের ইতিহাস বলে দেয় যে তারা ছিল বর্ণবাদী, সাম্রাজ্যবাদী এবং শোষণমুখী।


Thanks For Comment we are reply soon as possible.

Previous Post Next Post