বিজ্ঞান ও সামাজিক বিজ্ঞানের সংঘাত

নিউটনের গতিসূত্রগুলো আমাদের বেশ পরিচিত। বিশেষ করে তৃতীয় সূত্রটি, যা বলে, "প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া রয়েছে।" বিজ্ঞানের এই সূত্রগুলো সময়, স্থান, ও প্রেক্ষাপট নির্বিশেষে প্রযোজ্য, কারণ এগুলো নিরপেক্ষ তথ্য ও যুক্তির ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত। অন্যদিকে, অর্থনীতি, সমাজবিজ্ঞান, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, মনোবিজ্ঞান ইত্যাদি সামাজিক বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলো কি একইভাবে নিরপেক্ষ এবং সার্বজনীন?

এই প্রশ্নটি বর্তমান বিশ্বে বিশেষ করে মুসলিম সমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মুসলিম সমাজের বেশিরভাগ মানুষ এখনো পশ্চিমা বিশ্বকে তাদের প্রযুক্তিগত সাফল্যের জন্য সম্মান জানায় এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঙ্গে সামাজিক বিজ্ঞানকেও একই কাতারে স্থান দেয়। কিন্তু এই ধারণা কতটা যৌক্তিক?

বিজ্ঞানের নিরপেক্ষতা বনাম সামাজিক বিজ্ঞানের সাবজেক্টিভতা

বিজ্ঞান এবং বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রগুলো প্রকৃতি এবং বাস্তবতার গভীর পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে তৈরি। নিউটনের তৃতীয় গতিসূত্র যেমন সত্য, কারণ এর ভিত্তি পুরোপুরি পরীক্ষা, পর্যবেক্ষণ, ও গণনার ওপর। পদার্থবিজ্ঞান বা ক্যালকুলাসের মতো শাস্ত্রগুলো জায়গা, কাল, এবং প্রেক্ষাপটের বাইরে সত্য। এগুলো সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ এবং পজিটিভ শাস্ত্র।

কিন্তু পশ্চিমা সামাজিক বিজ্ঞানগুলো যে ধরনের ‘বৈজ্ঞানিক সত্য’ হিসেবে দাবি করা হয়, তা আসলেই কি পজিটিভ শাস্ত্রের অন্তর্ভুক্ত? এর ভিত্তি কি শুধুমাত্র যুক্তি, তথ্য, ও বাস্তবতার ওপর দাঁড়িয়ে আছে? প্রকৃতপক্ষে, সমাজবিজ্ঞান বা রাষ্ট্রবিজ্ঞান পশ্চিমা সভ্যতার বিশেষ ধ্যানধারণা, সামাজিক মূল্যবোধ, এবং নির্দিষ্ট আদর্শের ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। এগুলো সাধারণত সাবজেক্টিভ কারণ এগুলোর পেছনে আছে একটি নির্দিষ্ট দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি।

পশ্চিমা সামাজিক বিজ্ঞান: সেক্যুলার মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি

পশ্চিমা সামাজিক বিজ্ঞানের মূল উদ্দেশ্য হলো এমন একটি সমাজ তৈরি করা যা সেক্যুলার মূল্যবোধের ওপর ভিত্তি করে। এই মূল্যবোধগুলো মূলত স্রষ্টা, ধর্মীয় নীতি, এবং আধ্যাত্মিকতার বিপরীতে দাঁড়িয়ে থাকে। ফলে, ইসলামিক চিন্তাধারার সঙ্গে এই পশ্চিমা সামাজিক বিজ্ঞানের মৌলিক দ্বন্দ্ব বিদ্যমান। উদাহরণস্বরূপ, পশ্চিমা সমাজে ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যেখানে একজন ব্যক্তির নিজস্ব ইচ্ছা এবং স্বাধীনতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। কিন্তু ইসলামিক সমাজে, স্বাধীনতা এবং ব্যক্তিগত ইচ্ছা সব সময় আল্লাহর নির্দেশ এবং সমাজের কল্যাণের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পরিচালিত হয়।

ইসলামীকরণ প্রকল্প

পশ্চিমা সামাজিক বিজ্ঞানগুলোর ইসলামীকরণ প্রকল্পের উদ্দেশ্য ছিল পশ্চিমা জ্ঞানের বিভিন্ন শাখাকে ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে গড়ে তোলা। তবে, এই প্রকল্পটি মূলত তাত্ত্বিকভাবে ভুল। কারণ পশ্চিমা সামাজিক বিজ্ঞানের ভিত্তি এবং ইসলামের মৌলিক নীতিমালার মধ্যে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। সেক্যুলার সামাজিক বিজ্ঞানগুলো স্রষ্টার ধারণা এবং আধ্যাত্মিকতার উপস্থিতিকে সরিয়ে দিয়ে গড়ে উঠেছে। তাই, এগুলোকে ইসলামের মূলনীতি অনুযায়ী সংশোধন করার চেষ্টা এক ধরনের অবাস্তব উদ্যোগ। ইসলামের ওপর ভিত্তি করে একটি পূর্ণাঙ্গ বিকল্প সমাজ বিজ্ঞান গড়ে তোলাই সঠিক পন্থা হওয়া উচিত।

পশ্চিমা সামাজিক বিজ্ঞান ও তার ফলাফল

বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে পশ্চিমা সভ্যতার সাফল্য যেমন অসাধারণ, তেমনি সামাজিক ও নৈতিক ক্ষেত্রে তাদের ব্যর্থতাও গভীর। পশ্চিমা সমাজগুলোর পারিবারিক ও সামাজিক অবস্থা বর্তমানে চরম নৈতিক অবক্ষয়ের দিকে যাচ্ছে। সেখানে ডিভোর্সের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, জারজ সন্তান জন্ম নিচ্ছে, মাদকাসক্তি বাড়ছে, এবং সমকামিতা ও ট্রান্সজেন্ডার আন্দোলনের মতো বিষয়গুলো সামাজিকভাবে বৈধতা পাচ্ছে। এই অবক্ষয় প্রমাণ করে যে, পশ্চিমা সামাজিক বিজ্ঞানগুলো মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিকতার ক্ষেত্রে কার্যকর নয়।

এছাড়া, এই সমাজগুলোর মানুষগুলো জীবনে গভীর হতাশা এবং বিষণ্ণতার মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। পশ্চিমা আধুনিকতার প্রভাব মানবতার ওপর কেবল নৈতিক ক্ষতিই আনেনি, বরং তা মানুষকে মানবিক মূল্যবোধের সাথে সংযোগ স্থাপনে অক্ষম করে তুলেছে।

সেক্যুলারিজমের সাথে সামাজিক বিজ্ঞানগুলোর শেকড়

সামাজিক বিজ্ঞানগুলোর শেকড় খুঁজে পাওয়া যায় ষোড়শ শতাব্দীর ইউরোপে। সে সময়কার ক্যাথলিক চার্চের দুর্নীতি এবং পোপদের অনৈতিকতার কারণে ইউরোপে বিশ্বাসের সংকট তৈরি হয়। এই সংকটের প্রেক্ষাপটে ধর্মের পরিবর্তে যুক্তি ও বাস্তব জ্ঞানের ওপর ভিত্তি করে নতুন একটি সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তা গড়ে ওঠে। এই চিন্তার মূল উদ্দেশ্য ছিল ধর্মকে সীমাবদ্ধ করে ফেলা এবং সমাজকে ধর্মমুক্ত করা। ফলে, ইউরোপে সেক্যুলার চিন্তা এবং সামাজিক বিজ্ঞানগুলো ধর্মের বিকল্প হিসেবে আবির্ভূত হয়।

সেক্যুলার চিন্তার ভিত্তিতে পশ্চিমা সমাজের গঠন হওয়ায়, এই সামাজিক বিজ্ঞানগুলোর সাথে ইসলামের মৌলিক বিরোধ রয়েছে। ধর্মীয় ভিত্তিতে সামাজিক ও রাজনৈতিক চিন্তার বিকল্প হিসেবে গড়ে ওঠা এই শাস্ত্রগুলো ইসলামের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে পারে না।

ইসলামের মৌলিক পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর

ইসলাম এবং সেক্যুলারিজমের মধ্যে মৌলিক বিরোধ দেখা যায় জীবনের কিছু প্রধান প্রশ্নের উত্তর নিয়ে। ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গিতে এই প্রশ্নগুলোর উত্তর নির্দিষ্ট এবং স্পষ্ট। যেমন:

১. মহাবিশ্বের সূচনা কীভাবে হলো? ২. মানুষ কোথা থেকে এসেছে এবং তার লক্ষ্য কী? ৩. পরস্পরের প্রতি আচরণের নৈতিক ভিত্তি কী হওয়া উচিত? ৪. সমাজব্যবস্থা কেমন হওয়া উচিত? ৫. জ্ঞানের প্রকৃতি কী? কোন ধারণা বৈধ আর কোনটি অবৈধ?

এই প্রশ্নগুলোর উত্তর ইসলামের মধ্যে স্রষ্টা ও ধর্মের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত। অন্যদিকে, সেক্যুলারিজম এসব প্রশ্নের উত্তর দেয় স্রষ্টাকে বাদ দিয়ে যুক্তি, দর্শন, এবং বৈজ্ঞানিক তথ্যের ভিত্তিতে। এই কারণেই সেক্যুলার সামাজিক বিজ্ঞানগুলোর সাথে ইসলামের মৌলিক সাংঘর্ষিকতা রয়েছে।

নতুন দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন

মুসলিম সমাজের উচিত পশ্চিমা সামাজিক বিজ্ঞানগুলোকে অন্ধভাবে গ্রহণ না করা। বরং ইসলামের মৌলিক মূল্যবোধ ও নীতির ওপর ভিত্তি করে একটি স্বতন্ত্র সামাজিক বিজ্ঞান গড়ে তোলা জরুরি। ইবনু খালদুনের মতো মুসলিম চিন্তাবিদদের দর্শন থেকে শিক্ষা নিয়ে এবং প্রাসঙ্গিক ক্ষেত্রে পশ্চিমা জ্ঞানকে প্রয়োগ করে একটি পূর্ণাঙ্গ ইসলামিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা করা উচিত।

তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, পশ্চিমা সভ্যতার প্রযুক্তিগত সাফল্যের প্রভাবের কারণে মুসলিম সমাজের মধ্যে একটি স্বতঃসিদ্ধ বিশ্বাস তৈরি হয়েছে যে, সামাজিক বিজ্ঞানেরও ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত হতে হবে। এই বিশ্বাস থেকে সরে এসে ইসলামের ভিত্তিতে একটি নতুন চিন্তাভাবনার প্রয়োজনীয়তা এখন অত্যন্ত জরুরি।

Thanks For Comment we are reply soon as possible.

Previous Post Next Post