ঘৃণা উৎপাদনে মিডিয়ার ভূমিকা

বর্তমান বিশ্বে গণমাধ্যম শুধু তথ্যপ্রদান বা বিনোদনের একটি মাধ্যম নয়; এটি অনেক সময় মতামত ও মানসিকতারও একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হয়ে দাঁড়িয়েছে। মার্কিন সাংবাদিক ম্যাট টাইবির "HATE Inc." বইয়ে এই ঘৃণা উৎপাদন প্রক্রিয়াটি খুব সুক্ষ্মভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। টাইবি দেখিয়েছেন কিভাবে গণমাধ্যম প্রায়শই সঠিক তথ্য না দিয়ে মনগড়া ও বিদ্বেষমূলক বর্ণনা উপস্থাপন করে, যা সমাজে ঘৃণার জন্ম দেয়। তার বইয়ের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ে মার্কিন মিডিয়ার ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের সময় অস্তিত্বহীন ‘উইপেনস অফ ম্যাস ডেস্ট্রাকশন’ (WMD) এর মতো মিথ্যা গল্প প্রচার করার ক্ষেত্রে।

মিডিয়ার এই ঘৃণা উৎপাদনের গতিবিধি শুধু যুক্তরাষ্ট্রেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কার্যকরী হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও মিডিয়া অনেক ক্ষেত্রেই একটি ঘৃণা উৎপাদনের মেশিনে পরিণত হয়েছে, বিশেষ করে ইসলামের বিরুদ্ধে। টাইবির বইয়ের আলোকে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, কিভাবে দেশীয় মিডিয়া একই ঘৃণা উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছে এবং ধর্মীয় ও সামাজিক বিভেদকে উস্কে দিয়েছে।

মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধ এবং মার্কিন মিডিয়ার ভূমিকা

ম্যাট টাইবির বিশ্লেষণে স্পষ্টভাবে উঠে এসেছে কিভাবে মার্কিন মিডিয়া মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধকে জাস্টিফাই করেছে। "উইপেনস অফ ম্যাস ডেস্ট্রাকশান" এর অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য মিডিয়া যেমন বিশাল মিথ্যার অবতারণা করেছে, তেমনি যুদ্ধের তাত্ত্বিক ভিত্তি রচনায়ও প্রধান ভূমিকা পালন করেছে।

মিডিয়ার সেই সময়কার ভূমিকা ছিল সরাসরি মার্কিন যুদ্ধযন্ত্রের সাথে সহযোগিতামূলক। বিভিন্ন তথাকথিত 'বিশেষ সূত্র' ব্যবহার করে এমন অনেক তথ্য প্রচার করা হয়েছে, যার কোনও বাস্তব ভিত্তি ছিল না। মিডিয়ার এই প্রচারণা সরাসরি মুসলিমবিরোধী ঘৃণার উৎপাদন ও বিস্তারে ভূমিকা রেখেছে। এই ঘৃণা শুধু মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধ জাস্টিফাই করতেই সাহায্য করেনি, বরং যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিতে ইসলামিক সংস্কৃতি ও মূল্যবোধকে আক্রমণ করতেও সহায়ক হয়েছে।

এমবেডেড জার্নালিজম এবং মিডিয়ার যুদ্ধকে জাস্টিফাই করা

"এমবেডেড জার্নালিজম" ধারণার মাধ্যমে মিডিয়া যুদ্ধের সময় আরও সক্রিয় ভূমিকা পালন করে। মার্কিন সৈন্যরা যখন মুসলিম জনগণের ওপর নির্যাতন, ধর্ষণ ও হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছিল, মিডিয়া তখন সেই নৃশংসতাগুলোকে সঠিকভাবে উপস্থাপন না করে বরং মুসলিমদেরকে সন্ত্রাসী হিসেবে প্রমাণ করার চেষ্টা করেছে। টাইবি দেখিয়েছেন, কিভাবে মিডিয়া বারবার মুসলিমদের ওপর আক্রমণ চালানোর সময় তাদের 'বিশ্বাসের সমস্যাকে' দায়ী করেছে এবং সেই ভিত্তিতেই হামলার জাস্টিফিকেশন প্রদান করেছে।

হলিউড এবং যুদ্ধের ন্যায্যতা

টাইবি তার বইয়ে শুধু সংবাদমাধ্যমকেই দোষারোপ করেননি, বরং হলিউডকেও সমালোচনার কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়েছেন। "জিরো ডার্ক থার্টি," "হার্ট লকার," এবং "আমেরিকান স্নাইপার"-এর মতো সিনেমাগুলোতে মার্কিন বাহিনীর যুদ্ধকালীন কর্মকাণ্ডকে মহিমান্বিত করা হয়েছে। এই সিনেমাগুলোর মাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে যে, মার্কিন বাহিনী মধ্যপ্রাচ্যে যা করেছে তা ন্যায্য এবং বীরত্বপূর্ণ। বাস্তবিক অর্থে এগুলো ছিল নিরীহ মুসলিম জনগণের ওপর পরিচালিত একটি সুপরিকল্পিত গণহত্যা। এই চলচ্চিত্রগুলো মুসলিমবিরোধী ঘৃণাকে বৈধতা দেয় এবং পশ্চিমা দর্শকদের মধ্যে মুসলিমদের প্রতি বিদ্বেষ আরও বাড়িয়ে তোলে।

বাংলাদেশে মিডিয়ার ভূমিকা: একই প্যাটার্ন

মার্কিন মিডিয়ার ঘৃণা উৎপাদনের প্রক্রিয়াটি কেবল যুক্তরাষ্ট্র বা পশ্চিমা দেশগুলিতে সীমাবদ্ধ ছিল না। বাংলাদেশের মিডিয়াতেও অনেক ক্ষেত্রেই একই রকম ঘৃণা ছড়ানোর প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। বিশেষ করে ইসলাম এবং ইসলামী মূল্যবোধের বিরুদ্ধে মিডিয়া প্রায়শই বিদ্বেষমূলক বর্ণনা উপস্থাপন করে। ইসলামিক আচার-আচরণ এবং ধর্মীয় অনুশীলনকে অনেক সময় 'উগ্রতা' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়, যা মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে এক ধরনের ভয় ও বিভ্রান্তির জন্ম দেয়।

বাংলাদেশে ‘উগ্রতা’ শব্দটি মুসলমানদের অনেক সাধারণ ধর্মীয় কাজকর্মের সাথেও জড়িয়ে ফেলা হয়েছে। যেমন, "আসসালামু আলাইকুম" বলা, নারীদের পর্দা পালন, বা পুরুষদের দাড়ি রাখা—এই সবকিছুকেই উগ্রতার সাথে যুক্ত করে মিডিয়া এক ধরনের ভয় সৃষ্টি করছে। এর মাধ্যমে ইসলাম পালনকারী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হচ্ছে এবং সমাজে তাদেরকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দেওয়া হচ্ছে।

'সম্প্রীতি বাংলাদেশ' এবং মিথ্যামিডিয়ার ভূমিকা

"সম্প্রীতি বাংলাদেশ" এর মতো প্রতিষ্ঠান যখন ইসলামের কিছু দিককে উগ্রবাদ হিসেবে উপস্থাপন করে, তখন দেশের মিডিয়া সেই প্রচারণাকে আরও বাড়িয়ে তোলে। টাইবির বিশ্লেষণের আলোকে বলা যায়, দেশের মিডিয়া কোনো ধরনের জবাবদিহিতার মধ্যে না গিয়েই বছরের পর বছর ধরে ইসলামের বিরুদ্ধে প্রচার চালাচ্ছে। ইসলাম এবং ইসলাম পালনকারী জনগণের বিরুদ্ধে এমন এক ধরনের মনোভাব তৈরি করা হয়েছে, যা তাদেরকে সমাজের অন্যান্য অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করছে এবং তাদের ওপর হামলার বৈধতা তৈরি করছে।

ধর্মীয় বিদ্বেষ এবং গণমাধ্যমের পৃষ্ঠপোষকতা

টাইবির বইয়ে যেমনটি বলা হয়েছে, মার্কিন মিডিয়া যুদ্ধের সময় যেভাবে ঘৃণা তৈরি করেছিল, বাংলাদেশের মিডিয়াও সেই একই নীতি অবলম্বন করে যাচ্ছে। ধর্মীয় বিদ্বেষকে স্বাভাবিকীকরণ করার মাধ্যমে মিডিয়া এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করছে যেখানে ইসলাম এবং ইসলামী মূল্যবোধকে আক্রমণ করা খুব সহজ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। মিডিয়ার এই প্রচারণা শুধু ধর্মীয় বিদ্বেষকে বাড়িয়ে তুলছে না, বরং সহিংস আক্রমণের ক্ষেত্রও প্রস্তুত করছে।

বিভিন্ন সময়ে ইসলামী সংগঠন বা ইসলামের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ওপর হামলার সময় মিডিয়া সেই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিত পরিবর্তন করে আক্রমণকারীদেরকে মহিমান্বিত করে তোলে। এ ধরনের মিথ্যা বর্ণনা শুধুমাত্র সামাজিক বিভেদই বাড়ায় না, বরং ধর্মীয় বিদ্বেষকেও আরো তীব্র করে তোলে।

মিথ্যামিডিয়া এবং ইসলামী মূল্যবোধের বিরুদ্ধে আক্রমণ

টাইবি তার বইয়ে দেখিয়েছেন, কিভাবে মিডিয়া বিভিন্ন সময়ে মিথ্যা তথ্য প্রচার করে সমাজে বিভাজন সৃষ্টি করে। বাংলাদেশেও মিডিয়ার একই রকম ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়। ইসলামী মূল্যবোধ বা শরীয়াহর কোনো অংশ নিয়ে আলোচনা করার সময় মিডিয়া প্রায়শই এমনভাবে তা উপস্থাপন করে, যেন এগুলো সমাজের জন্য হুমকি। ইসলামের দণ্ডবিধি বা হুদুদ শাসন নিয়ে যেকোনো আলোচনাকে ‘সন্ত্রাসবাদ’ হিসেবে প্রচার করা হয়।

এই ধরনের প্রোপাগান্ডা শুধুমাত্র ইসলামী মূল্যবোধের বিরুদ্ধে ঘৃণার জন্ম দেয় না, বরং সমাজের মুসলিম জনগোষ্ঠীর ওপর এক ধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি করে। মুসলিমদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ ছড়ানোর মাধ্যমে গণমাধ্যম এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করছে, যেখানে তাদের অধিকার এবং ধর্মীয় স্বাধীনতাও হুমকির মুখে পড়ছে।

ঘৃণার স্বাভাবিকীকরণ এবং মিডিয়ার নৈতিক দায়িত্ব

মিডিয়ার একটি নৈতিক দায়িত্ব থাকে সমাজে শান্তি এবং সহমর্মিতার পরিবেশ তৈরি করা। কিন্তু যখন গণমাধ্যম সেই দায়িত্বকে ভুলে গিয়ে সমাজে ঘৃণা এবং বিভেদ ছড়ানোর হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখন সেটি শুধু সাংবাদিকতার নৈতিকতাকেই ধ্বংস করে না, বরং বৃহত্তর সমাজেরও ক্ষতি করে।

টাইবি তার বইয়ে ঘৃণা উৎপাদনের এই প্রক্রিয়ার নিন্দা করেছেন, এবং বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটেও আমরা এই ঘৃণার চক্র দেখতে পাচ্ছি। গণমাধ্যমের দায়িত্বশীলতার অভাব এবং বিদ্বেষমূলক প্রচারণা বাংলাদেশের সমাজকে বিভক্ত করছে এবং সহিংসতার পথ প্রশস্ত করছে।


Thanks For Comment we are reply soon as possible.

Previous Post Next Post