মডার্নিটি ও ইসলাম: সংঘাতের বাস্তবতা

মডার্নিটি, অর্থাৎ আধুনিকতা, আজকের বিশ্বে মানবজাতির জীবনের প্রতিটি দিককে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। এর প্রভাব যেমন বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, এবং সামাজিক কাঠামোতে দেখা যায়, তেমনই তা মানুষের চিন্তা, ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি, এবং নৈতিক মূল্যবোধকেও প্রভাবিত করেছে। আধুনিকতাবাদের (মডার্নিটির) উত্থান ইসলামের জন্য একটি গুরুতর চ্যালেঞ্জ হিসেবে দাঁড়িয়েছে। তবে মডার্নিটির প্রভাব বুঝতে হলে আমাদের কিছুটা পেছনে ফিরে তাকাতে হবে।

মডার্নিটির জন্ম: ইউরোপীয় সংকট ও সেক্যুলারিজমের উত্থান

মডার্নিটির জন্ম ষোড়শ শতাব্দীতে ইউরোপে রিফর্মেশান বা ধর্মীয় সংস্কারের মাধ্যমে হয়েছিল। এই সময়টিতে খ্রিষ্টধর্মের মধ্যে প্রচণ্ড মতভেদ এবং সংঘাতের সৃষ্টি হয়। ধর্মীয় যুদ্ধ, রক্তপাত, এবং বিভাজন বুদ্ধিজীবীদের মাঝে গভীর প্রশ্নের জন্ম দেয়। ধর্ম এবং বাইবেলকে তীব্র সমালোচনার মুখে ফেলে তারা মননশীলতার উপর জোর দেয়। এই ধারণা থেকে উদ্ভব হয় সেক্যুলারিজম, যা ধর্মকে সামাজিক এবং রাজনৈতিক জীবনের বাইরে রাখতে উৎসাহী করে তোলে।

মডার্নিটির মৌলিক ধারণা: মানব মন ও ক্ষমতার পূজা

মডার্নিটির সূচনালগ্নে যুক্তি ও অভিজ্ঞতাজাত পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে মানব-মনকে ঈশ্বরের স্থানে বসানো হয়। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির মাধ্যমে এই ধারণা আরও শক্তিশালী হয়। বিশেষত, নিউটনের পদার্থবিজ্ঞানের সাফল্য এবং গাণিতিক বিজ্ঞানের মাধ্যমে আধুনিকতাবাদীরা বিশ্বাস করে যে মানব-মন অসীম ক্ষমতা এবং আবিষ্কারের সক্ষমতা রাখে। তবে শুধু জ্ঞান নয়, প্রযুক্তির মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জনের প্রক্রিয়া মডার্নিটির এক অপরিহার্য অংশ। এই বিশ্বাসের ভিত্তি ছিল প্রগতিবাদের ওপর।

প্রগতিবাদ ও পরিবর্তনের প্রতি অন্ধ বিশ্বাস

মডার্নিটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো প্রগতিবাদ। এটি ধারণা দেয় যে, সময়ের সাথে সাথে মানুষের জ্ঞান ও ক্ষমতার অগ্রগতি ঘটে। প্রগতিবাদের উপর এই অন্ধ বিশ্বাস মানুষের মানসিকতাকে এমনভাবে প্রভাবিত করেছে যে, স্থিরতাকে অনৈতিক হিসেবে দেখা হয়। পরিবর্তনের প্রতি এই অসীম বিশ্বাসের কারণে ট্র্যাডিশানের (পূর্বেকার ধর্মীয় এবং সামাজিক নীতি ও সংস্কৃতির) প্রতি আস্থা হারিয়ে যায়। আর এখানেই মডার্নিটি এবং ইসলাম মুখোমুখি সংঘাতে আসে। কারণ ইসলাম পরিবর্তনের বিরুদ্ধে নয়, তবে চিরন্তন নীতি ও মূল্যবোধকে ধারণ করে।

মডার্নিটি বনাম ইসলাম: দর্শনগত দ্বন্দ্ব

ইসলাম এবং মডার্নিটির মধ্যে প্রধান পার্থক্য হলো, ইসলাম অতীতের জ্ঞানের সংরক্ষণ ও অনুসরণে বিশ্বাস করে, যেখানে মডার্নিটি নিরন্তর পরিবর্তন ও নবায়নকে মূল্য দেয়। ইসলাম মনে করে, মহান আল্লাহর একত্বের জ্ঞান মানুষের ফিতরাহ বা সহজাত প্রকৃতিতে রয়েছে, যা পরিবর্তনযোগ্য নয়। কিন্তু মডার্নিটি মনে করে, মানব-মন এবং যুক্তির মাধ্যমে সব প্রশ্নের উত্তর বের করা সম্ভব। এভাবেই মডার্নিটির দার্শনিক কাঠামো ইসলামকে অবজ্ঞা করে।

ঔপনিবেশিকতা ও ইসলামের বিরুদ্ধে মডার্নিটির আক্রমণ

ঔপনিবেশিক যুগে মডার্নিটির প্রভাবে ইউরোপীয় শক্তিগুলো ইসলামের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত আক্রমণ চালায়। মুসলিম-বিশ্বের অর্থনৈতিক ক্ষমতা দখলের পাশাপাশি, তারা মুসলিমদের মন-মানসিকতাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করে। ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং আলিমদের ধ্বংস করা হয়, ইসলামের সংস্কৃতিকে ধ্বংস করা হয়, আর মুসলিমদের উপনিবেশবাদী ধ্যান-ধারণার অধীনে আনা হয়।

প্রগতির পেছনে লুকানো বিপদ

মডার্নিটির প্রধান বিপদ হলো প্রগতিবাদের অন্ধ বিশ্বাস। মডার্নিটি প্রগতির নামে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের ওপর জোর দেয়। কিন্তু সব পরিবর্তন ইতিবাচক নয়। প্রগতির নামে সমাজের মূল্যবোধ এবং ধর্মীয় ট্র্যাডিশানকে ধ্বংস করা হয়। এই ধ্বংসাত্মক প্রবণতা ইসলামের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। ইসলাম প্রগতির বিরোধিতা করে না, তবে ইসলাম বিশ্বাস করে যে, কিছু মূল্যবোধ চিরন্তন এবং তা পরিবর্তন করা সম্ভব নয়।

আধুনিক মানসিকতার বিরুদ্ধে ইসলামের অবস্থান

মডার্নিটি মনে করে, ধর্মের আর কোনো প্রয়োজন নেই কারণ বিজ্ঞান এবং যুক্তি সব প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম। ডারউইনিজম, লিবারেলিজম, এবং নাস্তিকতা আধুনিক মানুষের প্রশ্নগুলির উত্তর দেয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু ইসলাম মনে করে, মানবজীবনের আসল উদ্দেশ্য হচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন। ধর্মই মানুষের সহজাত ফিতরাহর রক্ষক, যা মানুষকে কল্যাণের পথে পরিচালিত করে।

ইসলাম এবং আধুনিকতাবাদের পার্থক্য

মডার্নিটি এবং ইসলাম উভয়েই জীবন সম্পর্কে তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে সম্পূর্ণ বিপরীত। ইসলাম চিরন্তন নীতি ও মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, যেখানে মডার্নিটি পরিবর্তনের মাধ্যমে উন্নতির ধারণাকে প্রাধান্য দেয়। আধুনিকতাবাদ বিশ্বাস করে মানব সমাজ পরিবর্তনের মাধ্যমে প্রগতির পথে যেতে পারে, যেখানে ইসলাম মনে করে, মানব জাতির কল্যাণ চিরন্তন নীতির অনুসরণেই রয়েছে।

ইসলামি শিক্ষার গুরুত্ব

ইসলামি শিক্ষা মানুষের ফিতরাহকে সংরক্ষণ করে। মহান আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তাঁর একত্বে বিশ্বাস মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। ইসলামের বিধি-বিধানগুলো মানুষের ফিতরাহকে পরিষ্কার করে এবং মানুষকে আল্লাহর পথে নিয়ে যায়। ইসলামে কুরআন ও হাদিসের উপর ভিত্তি করে জীবনের সব প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া যায়।

মডার্নিটির প্রভাব আজকের সমাজে অত্যন্ত প্রবল। ইসলাম এই প্রভাবের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। মডার্নিটির অন্ধ পরিবর্তন ও প্রগতির ধারণা ইসলামের চিরন্তন নীতি ও মূল্যবোধের সাথে সাংঘর্ষিক। ইসলামের মূল শিক্ষা হলো মানুষের ফিতরাহ সংরক্ষণ এবং আল্লাহর প্রতি আনুগত্য বজায় রাখা। পরিবর্তনের এই প্রবাহের মুখে ইসলামের স্থায়িত্ব এবং ধ্রুব মূল্যবোধই মানুষকে প্রকৃত কল্যাণের দিকে নিয়ে যেতে পারে।


Thanks For Comment we are reply soon as possible.

Previous Post Next Post