প্রত্যেক প্রজেক্টের সঠিক সূচনা হলো একটি পরিষ্কার এবং প্রস্তুত স্থান থেকে শুরু করা। ঠিক যেমন বাড়ির মেরামতের ক্ষেত্রে পুরোনো রং তুলে ফেলে নতুন রং লাগাতে হয়, তেমনি সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সমস্যার সমাধানও শুরু করতে হবে পুরোনো, পচন ধরা কাঠামো ভেঙে। এই ধারণা শুধু বাড়ির মেরামতের জন্য প্রযোজ্য নয়, বরং আধুনিক সময়ের নানা সমস্যার সমাধানেও প্রযোজ্য। আমাদের সমাজের বর্তমান কাঠামো যদি পচন ধরা হয়, তবে এর ওপর ভিত্তি করে কোনো দীর্ঘস্থায়ী সমাধান তৈরি করা সম্ভব নয়।
পুরোনো কাঠামো ভেঙে নতুন গড়ার প্রয়োজনীয়তা
যেকোনো বড় পরিবর্তনের আগে বর্তমান কাঠামোকে ভালোভাবে বিশ্লেষণ করা জরুরি। আধুনিক বিশ্বের বিভিন্ন মতবাদ যেমন মডার্নিসম, লিবারেলিসম, সায়েন্টিসম, সেক্যুলারিসম ইত্যাদি অনেকের কাছে প্রগতির প্রতীক বলে বিবেচিত হলেও, এদের গভীরে রয়েছে এক গভীর সংকট। এই মতবাদগুলো ধীরে ধীরে ইসলামী চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করতে শুরু করেছে এবং ইসলামী চিন্তাবিদদেরও প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তাধারায় প্রবেশ করিয়েছে।
আসলেই কি এই মতবাদগুলো আমাদের সমাজে স্থায়ী সমাধান দিতে পারে? এসব মতবাদ শুধু সাময়িক সমাধান প্রদান করে, কিন্তু বাস্তবে তারা সমাজের মূল সমস্যাগুলোকে এড়িয়ে যায়। এর ওপর ভিত্তি করে তৈরি যে কোনো সমাজ কাঠামো হবে নড়বড়ে ও পতনোন্মুখ। সুতরাং, সমস্যার মূল সমাধানের জন্য প্রয়োজন পুরোনো কাঠামো ভেঙে নতুন করে ভাবনা শুরু করা।
ইসলামের দৃঢ় ভিত্তি
পূর্ববর্তী আলিমদের কাজের ওপর যে বরকত ছিল, তার প্রধান কারণ ছিল তারা একটি শক্ত মাটির ওপর কাজ করেছিলেন। তাদের চিন্তার ভিত্তি ছিল কুরআন ও সুন্নাহ, যা অটল, অবিচল, নিখুঁত এবং পরিপূর্ণ। তারা নিজেরা নতুন কোনো মতবাদ তৈরি করেননি; বরং তারা সালাফুস সালেহিনের রেখে যাওয়া জ্ঞানের আলোকে নিজেদের কাজ পরিচালনা করেছেন। ইসলামের এই শক্ত ভিত্তির কারণে তারা তৈরী করতে পেরেছিলেন এমন সব বুদ্ধিবৃত্তিক ও আত্মিক অর্জনের মনুমেন্ট যা আজও সমগ্র বিশ্বের জন্য একটি উদাহরণ হয়ে আছে।
আধুনিক সময়ে ইসলামের পুনর্জাগরণে বাধা
ইসলামের পুনর্জাগরণের পথে সবচেয়ে বড় বাধা হলো আধুনিক দর্শনের প্রভাব। বিশেষত, ইউরোপীয় মডার্নিস্ট চিন্তাধারার প্রসার ঘটতে থাকে বিশ্বজুড়ে, আর এর প্রভাব পড়ে মুসলিম বিশ্বেও। মুসলিম আলিমদের আলোচনা এবং কাজ তখন থেকেই প্রতিক্রিয়াশীল হতে শুরু করে। একদিকে এ ধরনের মতবাদের জবাব দেয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়, অন্যদিকে সামাজিক ও রাজনৈতিক চাপের কারণে অনেকে এসব মতবাদের আলোকে নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপন করতে শুরু করেন।
এভাবে মুসলিম স্কলারশিপে এক ধরনের পচন শুরু হয়। ইসলামী জ্ঞান ও চিন্তার মূল ভিত্তি ভুলে গিয়ে পশ্চিমা মতবাদগুলোর সাথে খাপ খাওয়ানোর চেষ্টা শুরু হয়। ফলে আধুনিক যুগের মুসলিম চিন্তাবিদদের কাজগুলো হয়ে ওঠে প্রতিক্রিয়াশীল এবং অস্থায়ী। এই পচন ধরা কাঠামোর ওপর ভিত্তি করে ইসলামের পুনরুত্থানের চিন্তা করা যেমন নড়বড়ে হবে, তেমনি দীর্ঘমেয়াদী সমাধান দেওয়ারও উপায় থাকবে না।
পচন ধরা কাঠামো ভাঙার সময় এসেছে
যদি আমরা সত্যিকারের দীর্ঘস্থায়ী সমাধান তৈরি করতে চাই, তবে প্রথমেই আমাদের করতে হবে পুরোনো পচন ধরা কাঠামোকে ভেঙে ফেলা। আমাদের আত্মবিশ্বাসের সাথে বলতে হবে যে মডার্নিসম, লিবারেলিসম, সায়েন্টিসম, সেক্যুলারিসম ইত্যাদির কোনো জায়গা নেই ইসলামী পুনর্জাগরণের মধ্যে। এগুলোকে ঝেটিয়ে বিদায় করতে হবে এবং পরিষ্কার, সমান মাটির ওপর নতুন করে শক্তপোক্ত কিছু নির্মাণ করতে হবে।
ইসলামের রাজকীয় সৌন্দর্য
ইসলাম তার প্রকৃত আকারে ফিরে আসলে এর সৌন্দর্য এতই অসাধারণ হবে যে, বিশ্বের কোনো কিছুই তার সাথে তুলনা করা যাবে না। ইসলাম তার শুদ্ধ আকারে ফিরে আসবে, বিইযনিল্লাহ। আর তা সম্ভব হবে তখনই যখন আমরা আধুনিক মতবাদগুলোকে ঝেটিয়ে বিদায় করে আবার কুরআন ও সুন্নাহর ভিত্তিতে নতুন করে কাজ শুরু করব। আমাদের চিন্তা করতে হবে ইসলামের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে, না যে কোনো আধুনিক মতবাদের ছায়ায়।
ইসলামি জ্ঞানের প্রকৃত উৎস
আমরা যদি ইসলামী পুনর্জাগরণে সফল হতে চাই, তবে আমাদের ফেরা উচিত ইসলামী জ্ঞানের প্রকৃত উৎসের দিকে। আলিমদের কাজগুলোতে এত বারাকাহ ছিল কারণ তারা কুরআন ও সুন্নাহ থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেছেন। তাদের ভিত্তি ছিল সালাফুস সালেহিনের রেখে যাওয়া জ্ঞান। বর্তমানের সমস্যার সমাধানও আমরা সেখান থেকেই পেতে পারি। আমাদের আলিমদের কাজ ছিল ইসলামী জ্ঞানের বিকাশ ঘটানো, কিন্তু তা আজ পশ্চিমা দর্শনের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে।
আধুনিক মুসলিম চিন্তাবিদদের চ্যালেঞ্জ
আধুনিক মুসলিম চিন্তাবিদদের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো এই পুরোনো, পচন ধরা কাঠামো থেকে বেরিয়ে আসা। আধুনিক যুগের সমস্যাগুলো সমাধানের জন্য যে পদ্ধতিতে কাজ করা হচ্ছে, তা প্রাথমিকভাবে ভুল। এসব সমস্যার সমাধান চাইলে প্রথমেই আমাদের করতে হবে সেই কাঠামো ভেঙে নতুন চিন্তাধারার জন্ম। আধুনিক চিন্তাধারা এবং মতবাদগুলো আমাদের জন্য কোনো সমাধান দিতে পারবে না। সুতরাং, আমাদের প্রত্যাশা রাখতে হবে ইসলামের সঠিক পথের ওপর।
নতুন একটি সূচনা
আমাদের ইসলামী পুনর্জাগরণ প্রক্রিয়াটি শুরু করতে হবে আত্মবিশ্বাসের সাথে। আমাদের ফিরতে হবে ইসলামের মূল ভিত্তির দিকে এবং প্রমাণ করতে হবে যে ইসলামের সাথে তুলনীয় কিছু নেই। যে কোনো সমাজের সমস্যা সমাধানে ইসলামই প্রকৃত সমাধান দিতে পারে। সুতরাং, পশ্চিমা চিন্তাধারার ছায়ায় না গিয়ে আমাদের চিন্তার জগৎকে আবার কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে গড়তে হবে। ইসলামের সাথে সম্পৃক্ত সত্যিকারের মাস্টারপিস গড়তে পারলেই আমরা সফল হতে পারব।
ইসলামের পুনর্জাগরণ এবং আধুনিক সমাজের সংকট মোকাবিলার জন্য আমাদের ফিরতে হবে ইসলামের প্রাথমিক সূত্রের দিকে। পুরোনো, পচন ধরা কাঠামো থেকে মুক্ত হয়ে নতুন করে কাজ শুরু করতে হবে। আধুনিক মতবাদগুলো আমাদের চিন্তাভাবনায় যতই প্রভাব ফেলুক না কেন, ইসলামের শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়েই আমরা পৃথিবীর সামনে আমাদের রাজকীয় সৌন্দর্য তুলে ধরতে পারব।