মানুষের সমাজে ন্যায়বিচার ও ক্ষমতার প্রশ্নে দুটি মূলধারার মতাদর্শ দীর্ঘদিন ধরে প্রচলিত আছে। একটি হলো গণতন্ত্র, যা পশ্চিমা সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত। অপরটি হলো শ'রীয়াহ্, যা ইসলামী আইন এবং নৈতিকতার উপর ভিত্তি করে গঠিত। বর্তমান প্রেক্ষাপটে, এই দুটি মতাদর্শের মধ্যে পার্থক্য এবং কোনটি মানুষের জন্য সঠিক পথ নির্ধারণ করে, তা নিয়ে অনেক বিতর্ক হয়। গণতন্ত্র কখনো কখনো মানুষের জন্য ন্যায়বিচার প্রদানে ব্যর্থ হয় এবং এর বিকল্প হিসেবে শ'রীয়াহ্ ন্যায়বিচার ও ইনসাফের পূর্ণ প্রতিফলন ঘটাতে পারে।
এই প্রবন্ধে গণতন্ত্র ও শ'রীয়াহ্ সম্পর্কে আলোচনা করা হবে। আমরা দেখব কেন গণতন্ত্র অনেক সময় ক্ষমতার অপব্যবহার, প্রতিহিংসা ও হানাহানির দিকে ধাবিত হয়, যেখানে শ'রীয়াহ্ ইনসাফ, ন্যায়বিচার ও ক্ষমার প্রতি গুরুত্ব দেয়। তাছাড়া, কেন গণতন্ত্রকে কিছু মানুষ গ্রহণ করে এবং শ'রীয়াহ্ অনুসরণের পরামর্শ দেয় সেই বিষয়েও আলোকপাত করা হবে।
গণতন্ত্র: ক্ষমতা ও জুলুমের শেকড়
গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি হলো জনগণের দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থা, যেখানে ক্ষমতা জনগণের হাতে থাকে এবং তারা তাদের প্রতিনিধি নির্বাচন করে। তবে, অনেক ক্ষেত্রে গণতন্ত্র একটি ব্যবস্থা হিসেবে মানুষের প্রকৃত ন্যায়বিচারের চেয়ে ক্ষমতা লোভী এবং প্রতিহিংসাপরায়ণ কর্মকাণ্ডের দিকে পরিচালিত হয়েছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় একটি সাধারণ প্রবণতা হলো ব্যক্তির ক্ষমতার প্রতি আকর্ষণ, যা অনেক সময় জুলুম এবং হানাহানির দিকে ধাবিত করে।
গণতন্ত্রের একটি বড় সীমাবদ্ধতা হলো ক্ষমতার প্রতিযোগিতা। রাজনৈতিক প্রার্থীরা নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা করতে ক্ষমতা লাভের জন্য নিজেদের মধ্যে প্রতিযোগিতা করে। এই প্রতিযোগিতা জনগণের কল্যাণের পরিবর্তে তাদের ব্যক্তিগত বা দলের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়। ফলে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার সাথে সাথে প্রতিহিংসা এবং জুলুমের প্রবণতা বাড়ে। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতায় থাকা ব্যক্তিরা প্রায়ই নিজেদের ক্ষমতা টিকিয়ে রাখার জন্য জুলুম এবং নির্যাতনের আশ্রয় নেয়, যা গণতন্ত্রের নামে আদতে অন্যায় হয়ে দাঁড়ায়।
গণতন্ত্রের আরেকটি বড় সমস্যা হলো বিভক্তি। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বা প্রার্থী জনগণকে বিভক্ত করতে বাধ্য করে, যার ফলে সমাজে হানাহানি এবং দলীয় হিংসার সৃষ্টি হয়। গণতন্ত্রের মাধ্যমে ক্ষমতা অর্জনের জন্য প্রতিশোধমূলক মনোভাব বৃদ্ধি পায়, এবং এই প্রতিহিংসার আগুন নেভানোর বদলে বরং তা আরও জ্বলতে থাকে। ক্ষমতার লোভ এবং দলীয় বিভক্তির এই খেলায় সাধারণ মানুষের কল্যাণ এবং ন্যায়বিচারের প্রশ্ন পিছনে চলে যায়।
শ'রীয়াহ্: ন্যায়বিচার ও ইনসাফের প্রতীক
অপরদিকে শ'রীয়াহ্ সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের একটি শাসনব্যবস্থা। শ'রীয়াহ্ ইসলামী আইনের ভিত্তিতে পরিচালিত হয়, যার মূল লক্ষ্য হলো ইনসাফ, ন্যায়বিচার এবং মানুষের মধ্যে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করা। শ'রীয়াহ্ শুধু একটি আইন নয়, এটি একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা, যা মানুষের প্রতিটি কার্যক্রমে ন্যায় এবং ইনসাফকে অগ্রাধিকার দেয়।
শ'রীয়াহ্-তে ক্ষমতা কেবলমাত্র আল্লাহর হাতে। এই ব্যবস্থায় কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী নিজেকে ক্ষমতার জন্য প্রতিযোগিতা করতে পারে না। শূরার মাধ্যমে একজন নেতৃত্বস্থাপিত হন, যেখানে শুধুমাত্র যোগ্য ও সৎ ব্যক্তিদের মধ্যে থেকে নেতৃত্ব নির্বাচন করা হয়। শ'রীয়াহ্ নেতৃত্বে কোনো প্রতিযোগিতা বা ক্ষমতার লোভ নেই। বরং এতে ব্যক্তিগত ক্ষমতা প্রদর্শনের চেয়ে ন্যায়বিচারের মাধ্যমে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই মুখ্য।
শ'রীয়াহ্-তে ক্ষমার গুরুত্ব অপরিসীম। শ'রীয়াহ্ বিশ্বাস করে যে, মানুষকে ক্ষমা করা মহান গুণ, এবং তা সমাজে শান্তি এবং স্থিতি বজায় রাখে। ইসলামী শাসনব্যবস্থায় ক্ষমার মাধ্যমে শাসক এবং প্রজা উভয়ের মধ্যে পারস্পরিক সম্মান এবং দায়বদ্ধতা গড়ে ওঠে। অপরাধীকে শাস্তি দেওয়ার পাশাপাশি তাকে সংশোধনের সুযোগ প্রদান করা হয়, যা সমাজে নৈতিকতার ভিত্তি মজবুত করে। শ'রীয়াহ্-তে ক্ষমার নীতি আল্লাহর ন্যায়বিচারের উপর প্রতিষ্ঠিত, যেখানে প্রতিটি মানুষকে ন্যায়ের প্রতি দায়বদ্ধ হতে শেখানো হয়।
কেন মানুষ গণতন্ত্র চায়?
যদিও শ'রীয়াহ্ একটি ন্যায়বিচারপূর্ণ এবং শান্তিপূর্ণ সমাজের প্রতিশ্রুতি দেয়, তারপরও মানুষ কেন গণতন্ত্রের দিকে ঝোঁক? এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ বিদ্যমান। প্রথমত, অনেক মানুষ গণতন্ত্রকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতার প্রতীক হিসেবে দেখে। গণতন্ত্রের মাধ্যমে তারা নিজেদের মতামত প্রকাশ করার এবং ব্যক্তিগত অধিকার রক্ষার সুযোগ পায় বলে বিশ্বাস করে। গণতন্ত্রে সবাই নিজ নিজ স্বার্থের জন্য প্রতিযোগিতা করতে পারে, যা অনেক মানুষের কাছে আকর্ষণীয় মনে হয়।
দ্বিতীয়ত, গণতন্ত্র অনেক ক্ষেত্রে একটি বিশ্বজনীন মতাদর্শ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্ব গণতন্ত্রকে একটি সর্বোত্তম শাসনব্যবস্থা হিসেবে প্রচার করেছে, এবং অনেকে বিশ্বাস করে যে গণতন্ত্রই সেরা উপায় ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার জন্য। গণতন্ত্রের মাধ্যমে মানুষ তাদের নিজস্ব প্রতিনিধি নির্বাচন করতে পারে এবং একটি গণপ্রজাতন্ত্রী ব্যবস্থায় নিজেদের অধিকার সুরক্ষিত রাখে বলে মনে করে। গণমাধ্যম এবং রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে গণতন্ত্রের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
তৃতীয়ত, কিছু মানুষ শ'রীয়াহ্ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা পোষণ করে। শ'রীয়াহ্ সম্পর্কে ভুল তথ্য এবং অপব্যাখ্যা তাদেরকে গণতন্ত্রের প্রতি আকৃষ্ট করে। অনেকে শ'রীয়াহ্-কে কঠোর এবং নিপীড়নমূলক আইন বলে মনে করে, যদিও প্রকৃতপক্ষে শ'রীয়াহ্ ইনসাফ এবং ক্ষমার মাধ্যমে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করে। এ কারণে মানুষ শ'রীয়াহ্-র বিকল্প হিসেবে গণতন্ত্রের প্রতি ঝোঁক দেখায়।
শ'রীয়াহ্ বনাম গণতন্ত্র
গণতন্ত্র ও শ'রীয়াহ্-র মধ্যে মূল পার্থক্য হলো ক্ষমতার বিন্যাস এবং ন্যায়বিচারের প্রশ্ন। গণতন্ত্র একটি মানুষকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা, যেখানে ক্ষমতা অর্জন ও প্রয়োগের জন্য প্রতিযোগিতা এবং সংঘাত প্রায় অপরিহার্য। এতে রাজনৈতিক লড়াই এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে জুলুম এবং অন্যায়ের পথ প্রশস্ত হয়। অপরদিকে, শ'রীয়াহ্ আল্লাহর নির্দেশিত নীতির উপর ভিত্তি করে পরিচালিত হয়, যা ন্যায়বিচার, ইনসাফ এবং মানুষের মধ্যে শান্তি ও ক্ষমার প্রতিফলন ঘটায়।
গণতন্ত্রের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার প্রক্রিয়া। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে একজন ব্যক্তি বা দল ক্ষমতায় আসতে গেলে তাকে রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। এই প্রতিযোগিতা অনেক সময় ব্যক্তিগত স্বার্থ এবং ক্ষমতার লোভকে উসকে দেয়, যার ফলশ্রুতিতে জুলুম এবং হিংসা বৃদ্ধি পায়। গণতন্ত্রে যারা ক্ষমতায় থাকে তারা প্রায়শই নিজেদের স্বার্থ রক্ষা করতে অন্যদের প্রতি জুলুম করতে বাধ্য হয়।
অন্যদিকে, শ'রীয়াহ্-তে ক্ষমতা শুধুমাত্র আল্লাহর নির্দেশনায় পরিচালিত হয় এবং শূরার মাধ্যমে নেতা নির্বাচন করা হয়। শ'রীয়াহ্ নেতৃত্বে কোনো প্রতিযোগিতা বা ক্ষমতার লোভ নেই, বরং এতে ন্যায়বিচার ও ইনসাফের মাধ্যমে সমাজে স্থিতি বজায় রাখার প্রচেষ্টা করা হয়। শ'রীয়াহ্-তে প্রতিটি মানুষকে ন্যায়ের প্রতি দায়বদ্ধ থাকতে শেখানো হয়, এবং অপরাধীর প্রতি ক্ষমাশীলতা প্রদর্শন করে শান্তিপূর্ণ সমাজ গড়ে তোলার পথ সুগম করা হয়।
গণতন্ত্র ও শ'রীয়াহ্ দুটি ভিন্নধর্মী শাসনব্যবস্থা, যেখানে একদিকে গণতন্ত্র মানুষের মধ্যে ক্ষমতার প্রতিযোগিতা, জুলুম এবং হানাহানির দিকে ধাবিত হয়, অন্যদিকে শ'রীয়াহ্ ন্যায়বিচার, ইনসাফ এবং ক্ষমার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ সমাজ তৈরিতে সহযোগিতা করে।