ছাত্র রাজনীতি প্রয়োজনীয় সংস্কার

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ছাত্র রাজনীতি এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। জাতির স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে শুরু করে বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক সংগ্রামে ছাত্রদের ভূমিকা সবসময় উল্লেখযোগ্য। কিন্তু বর্তমান সময়ের ছাত্র রাজনীতি অনেক ক্ষেত্রেই আদর্শের বিপরীত দিকে অবস্থান করছে। এ ধরনের ছাত্র রাজনীতির কারণে সমাজ এবং শিক্ষাব্যবস্থার ক্ষতি হচ্ছে, এবং শিক্ষার্থীদের মেধা বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে ছাত্র রাজনীতির সংস্কার অত্যন্ত জরুরি হয়ে পড়েছে। এই ব্লগে আমরা ছাত্র রাজনীতির বর্তমান অবস্থা, সমস্যা এবং এর সমাধানের জন্য প্রয়োজনীয় নীতিমালা সম্পর্কে আলোচনা করবো।


ছাত্র রাজনীতির ইতিহাস ও অবদান

ছাত্র রাজনীতি বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি শক্তিশালী মাধ্যম ছিল। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, এবং ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ছাত্রদের অবদান অপরিসীম। ছাত্র রাজনীতি জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সব ইস্যুতে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং তরুণদের মধ্যে দেশপ্রেম ও সামাজিক সচেতনতা জাগ্রত করেছে।


কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে ছাত্র রাজনীতির ধারা পরিবর্তন হতে শুরু করে। বর্তমান সময়ে ছাত্র সংগঠনগুলো অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক দলের প্রভাবের অধীন হয়ে পড়েছে। এই প্রভাব ছাত্রদের মধ্যে মতপার্থক্য, সহিংসতা এবং দলাদলির সৃষ্টি করছে। ফলে শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য এবং জাতি গঠনের যে ভিত্তি, তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।


বর্তমান ছাত্র রাজনীতির সমস্যা:

১. রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব

বর্তমান ছাত্র রাজনীতি সরাসরি জাতীয় রাজনৈতিক দলের প্রভাবাধীন। ছাত্র সংগঠনগুলো মূলত রাজনৈতিক দলের অঙ্গসংগঠন হিসেবে কাজ করছে, যা শিক্ষার পরিবেশকে নষ্ট করছে। শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের স্বার্থ হাসিল করছে, যা শিক্ষাব্যবস্থায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করছে।


২. সহিংসতা ও দমননীতি

বর্তমান ছাত্র রাজনীতির আরেকটি ভয়াবহ দিক হলো সহিংসতা। রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াইয়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে প্রায়ই মারামারি, হামলা, এবং ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম দেখা যায়। এসব কর্মকাণ্ড শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শান্তি ও শৃঙ্খলা ভঙ্গ করছে, যার ফলে শিক্ষার্থীরা ভয় ও আতঙ্কের মধ্যে সময় পার করছে।


৩. মেধা ও শিক্ষার গুরুত্ব উপেক্ষা

ছাত্র রাজনীতির কারণে শিক্ষার্থীরা তাদের শিক্ষার মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হচ্ছে। রাজনৈতিক সভা, মিছিল এবং অন্যান্য কর্মসূচিতে অংশ নিতে গিয়ে শিক্ষার্থীরা তাদের লেখাপড়া উপেক্ষা করছে, ফলে তাদের একাডেমিক ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এছাড়া, শিক্ষার্থীরা যদি রাজনীতি করতে গিয়ে নিজেদের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তারা যোগ্য নেতৃত্ব দিতে পারবে না।


ছাত্র রাজনীতির সংস্কারের প্রস্তাবিত নীতিমালা

এই সমস্যাগুলোর সমাধানের জন্য ছাত্র রাজনীতির একটি সুসংহত নীতিমালা প্রণয়ন করা প্রয়োজন। নিচে কিছু প্রস্তাবিত নীতিমালা দেওয়া হলো:


১. বয়সের সীমাবদ্ধতা: ১৮ বছরের আগে রাজনীতি নয়

যেমন ভোটার হতে ১৮ বছর বয়স পূর্ণ হতে হয়, তেমনি ১৮ বছরের আগে কোনো ছাত্রকে রাজনীতিতে সম্পৃক্ত করা উচিত নয়। ১৮ বছর বয়সের পর একজন ছাত্র তার নিজস্ব বিচারবুদ্ধি এবং জ্ঞান অনুযায়ী রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করতে পারবে। এই নীতিমালা প্রণয়নের ফলে কমবয়সী শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক দৌড়ঝাঁপ থেকে নিজেদের দূরে রাখতে পারবে এবং শিক্ষা নিয়ে বেশি মনোনিবেশ করবে।


২. ছাত্র রাজনীতি শুধু বিদ্যাপীঠের মধ্যে সীমাবদ্ধ

ছাত্র রাজনীতি তার নিজস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত। বাইরের রাজনৈতিক প্রভাব থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে মুক্ত রাখতে হবে। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শৃঙ্খলা বজায় থাকবে এবং শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক দাঙ্গা বা বিরোধে জড়াবে না।


৩. গঠনতন্ত্রের নিয়ম মেনে চলা

প্রত্যেক ছাত্র সংগঠনকে তাদের নিজস্ব গঠনতন্ত্রের ভিত্তিতে পরিচালিত হতে হবে। তাদের কার্যক্রম এবং সিদ্ধান্ত গঠনতন্ত্রের নিয়মের বাইরে হতে পারবে না। এই নীতিমালা প্রণয়নের ফলে ছাত্র সংগঠনগুলো সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হবে এবং অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকবে।


৪. জাতীয় ইতিহাস ও নেতাদের ভূমিকা পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্তি

ছাত্ররা যাতে ভবিষ্যতে জাতীয় নেতৃত্ব দিতে পারে, সেজন্য তাদের সঠিক ইতিহাস এবং জাতীয় নেতাদের ভূমিকা সম্পর্কে সচেতন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পাঠ্যপুস্তকে জাতীয় নেতা এবং গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার যথাযথ বিবরণ থাকতে হবে। এর ফলে শিক্ষার্থীরা দেশপ্রেম, নৈতিকতা, এবং আদর্শের ভিত্তিতে নিজেকে গড়ে তুলতে পারবে।


৫. এক প্রতিষ্ঠানের ছাত্র অন্য প্রতিষ্ঠানে রাজনীতি করতে পারবে না

একজন ছাত্র তার নিজস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে ছাত্র রাজনীতি করতে পারবে না। এতে বাইরের রাজনৈতিক চাপ এবং হস্তক্ষেপ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো মুক্ত থাকবে। এতে শিক্ষার পরিবেশ সুস্থ থাকবে এবং শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক চাপে পড়বে না।


৬. ছাত্রত্ব শেষে রাজনীতি নিষিদ্ধ

যেদিন থেকে একজন ছাত্র তার শিক্ষাজীবন শেষ করবে, সেদিন থেকেই তার ছাত্র রাজনীতি করার অধিকার শেষ হয়ে যাবে। এর ফলে যারা পড়াশোনা শেষ করে ফেলেছে, তারা আর ছাত্র সংগঠনের মাধ্যমে রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করতে পারবে না এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হবে না।


৭. মূল রাজনৈতিক দলের প্রভাব নিষিদ্ধ

ছাত্র সংগঠনের কোনো সিদ্ধান্তে জাতীয় রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো হস্তক্ষেপ থাকবে না। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে মতানৈক্য এবং সহিংসতা অনেকাংশেই রাজনৈতিক দলের কারণে ঘটে। এই নীতিমালা কার্যকর হলে ছাত্ররা রাজনৈতিক স্বাধীনতা ভোগ করতে পারবে এবং নিজেদের মতামত স্বাধীনভাবে প্রকাশ করতে পারবে।


৮. জাতীয় ইস্যুতে ছাত্রদের অংশগ্রহণ

যদি ছাত্রদের কোনো জাতীয় ইস্যুতে অংশ নিতে হয়, তাহলে তা তার নিজস্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বের মাধ্যমে হবে। এতে ছাত্ররা দেশের সেবা করতে পারবে, তবে এটি শিক্ষার পরিবেশ নষ্ট করবে না।


৯. বিবাহিত ছাত্রদের রাজনীতি নিষিদ্ধ

ছাত্র জীবনে যারা বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবে, তারা কোনো ছাত্র সংগঠনে সম্পৃক্ত হতে পারবে না। এতে তারা পরিবার এবং শিক্ষা নিয়ে বেশি মনোযোগ দিতে পারবে এবং রাজনৈতিক কাজে নিজেদের জড়াবে না।


১০. অনিয়মিত শিক্ষার্থীদের জন্য নিষেধাজ্ঞা

যারা পড়াশুনায় নিয়মিত নয়, তারা কোনো ছাত্র সংগঠনের সদস্য হতে পারবে না। এতে শিক্ষার্থীরা শিক্ষার প্রতি মনোযোগী হবে এবং রাজনীতিতে জড়াবে না। এছাড়া, এতে ছাত্র সংগঠনগুলোতে যোগ্য নেতৃত্ব তৈরি হবে।


১১. ছাত্র সংগঠনের গঠনতন্ত্র আদালত কর্তৃক অনুমোদিত হতে হবে

প্রত্যেক ছাত্র সংগঠনের গঠনতন্ত্রকে সর্বোচ্চ আদালত দ্বারা অনুমোদিত হতে হবে। এতে ছাত্র সংগঠনগুলোতে শৃঙ্খলা এবং সুশাসন বজায় থাকবে এবং আইন অনুযায়ী পরিচালিত হবে।


১২. প্রতিহিংসা মূলক কার্যক্রম নিষিদ্ধ

যদি কোনো ছাত্র সংগঠন তার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে অন্য কোনো সংগঠনের বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, তাহলে সেই সংগঠনের কার্যক্রম সেই প্রতিষ্ঠানে বন্ধ করে দেওয়া হবে। তবে, এই সিদ্ধান্ত একটি নিরপেক্ষ জুডিশিয়ারি তদন্তের মাধ্যমে নেওয়া হবে।


ছাত্র রাজনীতি ও নৈতিকতা:

ছাত্র রাজনীতি কেবলমাত্র শিক্ষার্থীদের রাজনৈতিক অধিকার নিশ্চিত করার জন্য নয়, বরং এটি তাদের নৈতিক শিক্ষা এবং দায়িত্ববোধ জাগ্রত করার জন্যও প্রয়োজন। একজন ছাত্রকে শুধু রাজনৈতিক কার্যকলাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়; তাকে হতে হবে সমাজসচেতন, দেশপ্রেমিক, এবং নৈতিকতার প্রতি দায়বদ্ধ।


ছাত্র রাজনীতি যদি সঠিকভাবে পরিচালিত হয়, তবে এটি সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারে এবং তরুণ প্রজন্মকে একটি দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। কিন্তু যদি এটি রাজনৈতিক দলগুলোর হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তবে তা শিক্ষাব্যবস্থা এবং সমাজের জন্য বিপজ্জনক। তাই ছাত্র রাজনীতির জন্য একটি সুসংহত এবং আদর্শিক নীতিমালা প্রণয়ন করা অত্যন্ত জরুরি। শিক্ষার্থীরা যেন তাদের শিক্ষাজীবন সঠিকভাবে শেষ করে এবং ভবিষ্যতে যোগ্য নেতা হতে পারে, সেজন্য সুষ্ঠু শিক্ষার পরিবেশ তৈরি করতে হবে।


এই প্রস্তাবিত নীতিমালাগুলো বাস্তবায়িত হলে ছাত্র রাজনীতির আদর্শিক ধারা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে, যা দেশের উন্নয়ন এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্ব তৈরি করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।

©দিলোয়ার হোসেন। 

Thanks For Comment we are reply soon as possible.

Previous Post Next Post