ইসলাম একটি এমন ধর্ম যা সর্বদা ঐক্যের দিকে আহ্বান করে। ইসলাম সম্পর্কে যার যতবেশি জ্ঞান রয়েছে, তিনি ততই মানুষের মাঝে ঐক্য স্থাপনের চেষ্টা করেন। পক্ষান্তরে, ইসলাম সম্পর্কে যার জ্ঞান সীমিত, তার দ্বারা সমাজে ফিতনার সৃষ্টি হয়, যা ঐক্য বিনষ্ট করে। আল্লাহর জ্ঞান ও নির্দেশনা অনুসারে যারা জীবন পরিচালনা করেন, তারা বুঝতে পারেন যে মুসলমানদের একতাবদ্ধ থাকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু যারা অজ্ঞ, তারা নিজের মতামত ও আকিদাকে অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে এবং বিভেদের আগুনে ঘি ঢালে।
জ্ঞানী ব্যক্তিরা সবসময় বলেন, “এসো আমরা এক হই, যা আমাদের মধ্যে সাদৃশ্য রয়েছে তার ওপর ভিত্তি করে। মতবিরোধের বিষয়ে মহান আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা কিয়ামতের দিনে বিচার করবেন।” এই মনোভাব ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে উৎসারিত, যা একতাবদ্ধ সমাজ গঠনের জন্য অপরিহার্য। মতপার্থক্য থাকলেও তা কোনোভাবেই মুসলিমদের ঐক্য বিনষ্ট করতে পারে না, যদি সেই মতপার্থক্যকে যথাযথভাবে সামলে নেওয়া যায়।
জ্ঞানী আলেমরা বুঝেন যে ইসলামে ঐক্য সৃষ্টির মূলে রয়েছে এক আল্লাহর ওপর ঈমান ও রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সুন্নাহ। তারা মতবিরোধকে দ্বিতীয় স্তরে রাখেন এবং ইসলামের মূল শিক্ষাকে কেন্দ্র করে সবাইকে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানান। তাদের মতে, মতপার্থক্য থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু তা কখনোই মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে পারে না।
ফিতনার মূল কারণ
অপরদিকে, যারা ফিতনা সৃষ্টি করে, তাদের মূল লক্ষ্যই হলো বিভক্তি সৃষ্টি করা। তারা বলেন, “আমরা অন্যদের থেকে আকিদায় শ্রেষ্ঠ, তাই আমরা একত্রিত হব না।” এই মনোভাবের কারণে মুসলিম সমাজে ফিতনা সৃষ্টি হয়, যা ঐক্যকে ভেঙে ফেলে।
ঐক্য না হওয়ার কিছু প্রধান কারণ হলো:
১. নেতাদের ক্ষমতার লোভ: অনেক নেতা ব্যক্তিগত স্বার্থে ইসলামের সঠিক শিক্ষাকে পাশ কাটিয়ে ক্ষমতার লড়াইয়ে লিপ্ত হন।
২. অন্যের সফলতায় হিংসা: একজন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর সাফল্য দেখে অন্যরা হিংসা অনুভব করে, ফলে ঐক্য বিনষ্ট হয়।
৩. নিজের মতামতকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া: নিজের মতামত বা আকিদাকে অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠ মনে করে একত্রিত হওয়ার চেষ্টা না করা।
৪. ঈমানি চেতনার অভাব: ঈমানের দুর্বলতা থাকলে ব্যক্তির মনে ইসলামিক একতাবোধ গড়ে ওঠে না।
৫. নিজের স্বার্থে ফতোয়া দেওয়া: ব্যক্তিগত স্বার্থে ইসলামী ফতোয়া দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, যা ফিতনা বৃদ্ধি করে।
ইসলামের ঐক্যের প্রকৃত শিক্ষা
ইসলামে ঐক্য একান্ত গুরুত্বপূর্ণ, আর এ বিষয়ে এক অনন্য দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় মুয়াবিয়া (রা.) এবং আলী (রা.) এর মধ্যে মতবিরোধের সময়ে। তখন এক খ্রিস্টান রাজা মুয়াবিয়া (রা.) কে বলেন, “হে মুয়াবিয়া, আমি তোমাকে সাহায্য করতে চাই আলীর (রা.) বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য সৈন্য এবং হাতিয়ার দিয়ে।” তখন মুয়াবিয়া (রা.) বলেন, “হে খ্রিস্টান সম্রাট, তুমি ভাল করে শুনে রাখো, তুমি যদি আলীর (রা.) বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করো, আমি মুয়াবিয়া সর্ব প্রথম আলীর পক্ষে যুদ্ধে নামব। তোমাকে যুদ্ধে সামনে পেলে তোমার কল্লা আলাদা করে দিব।”
এই বক্তব্যে স্পষ্টভাবে বোঝা যায় যে মুয়াবিয়া (রা.) ইসলামের ঐক্যকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছেন। যদিও তাদের মধ্যে মতপার্থক্য ছিল, কিন্তু যখন বাইরের শত্রুরা মুসলমানদের ঐক্য ভাঙার চেষ্টা করেছিল, তখন তিনি ইসলামের ঐক্যের পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নিয়েছিলেন।
ঐক্যের গুরুত্ব
ইসলামি ঐক্যের মূলমন্ত্র হলো এক কালিমার ভিত্তিতে এক হওয়া। আল্লাহর ওপর ঈমান ও রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সুন্নাহ মেনে চলা ছাড়া মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য আসবে না। মতবিরোধ থাকতে পারে, কিন্তু তা ঐক্য বিনষ্ট করতে পারে না, যদি আমরা সঠিক পথে চলি।
ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী, বিভেদ এবং ফিতনা মুসলিম উম্মাহর জন্য সবচেয়ে বড় বিপদ। যারা বিভেদ সৃষ্টি করে, তারা আসলে ইসলামের মূল শিক্ষার বিপরীতে কাজ করছে। তাই আমাদের উচিত আল্লাহর প্রতি পূর্ণ ঈমান রেখে, মতপার্থক্যকে পাশ কাটিয়ে ইসলামের সাদৃশ্যপূর্ণ বিষয়গুলোকে কেন্দ্র করে ঐক্য গঠন করা।
মুসলমানদের উচিত নিজেদের মাঝে ঐক্য স্থাপন করা এবং আল্লাহর ওপর পূর্ণ আস্থা রাখা। ইসলাম আমাদের শিক্ষা দেয় একতাবদ্ধ থাকার জন্য, আর যারা এই শিক্ষাকে উপেক্ষা করে, তারা ফিতনা সৃষ্টি করে। আমাদের মনে রাখতে হবে, মতবিরোধ কিয়ামতের দিনে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ'লা বিচার করবেন, কিন্তু আমাদের আজকের কাজ হলো একতাবদ্ধ হওয়া। এক কালিমার ওপর ভিত্তি করে ঐক্য স্থাপন করলেই আমরা ফিতনা এবং বিভেদ থেকে রক্ষা পেতে পারি।