রাজনীতির দুষ্টচক্র

রাজনীতি আর ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, ইতিহাসের প্রাচীন অধ্যায় থেকেই চলে আসছে। এই দুষ্টচক্রে আমরা বারবার দেখি কিভাবে একটি গোষ্ঠী অন্য আরেকটি গোষ্ঠীকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে। সাধারণ জনগণ ও শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করে এ চক্রের কৌশলগত খেলা আজও অব্যাহত রয়েছে। বর্তমান সময়ে দেখা যায়, এই রাজনৈতিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে সাধারণ মানুষ বিশেষ করে ছাত্রসমাজকে ব্যবহার করে একদল ক্ষমতালোভী কে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে আরেক দল  ক্ষমতালোভীকে ক্ষমতায় আনা হয়। এটি একটি চক্রাকারে আবর্তিত হয়, যেখানে জনগণ শোষিত হতে থাকে, আর কিছু গোষ্ঠী তাদের স্বার্থসিদ্ধি করে চলে।

এই ব্লগে আমরা আলোচনা করবো কিভাবে রাজনৈতিক দুষ্টচক্র সাধারণ মানুষকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে, ইসলামের আলোকে তাওহীদপন্থী নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা এবং একটি আদর্শ সমাজ প্রতিষ্ঠার উপায়।

রাজনৈতিক চক্রে শিক্ষার্থী সমাজের ব্যবহার

রাজনীতিতে ছাত্রসমাজ সবসময়ই একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, বিপ্লব বা আন্দোলনের মূলে ছাত্ররা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে দুঃখজনক হলো, ক্ষমতালোভী কিছু গোষ্ঠী ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ এবং বিপ্লবী চেতনাকে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করে। তাদের মন্ত্রণা ও প্রভাবিত করা হয় জাতীয়তাবাদ, বৈষম্য বা ধর্মীয় উস্কানিতে। ফলে ছাত্র সমাজ তাদের মুক্তিকামী চেতনার বাইরে এই রাজনীতির শিকার হয়। একদলকে হটিয়ে আরেক দলকে আনার জন্য প্রতিনিয়ত ব্যবহৃত হয় তাদের রক্ত, ত্যাগ, আবেগ এবং তাদের মূল্যবান সময়।

এই ব্যবহারিক রাজনৈতিক খেলায় ছাত্রসমাজ একদিকে সমাজ ও জাতিকে নেতৃত্ব দেওয়ার প্রস্তুতি হারিয়ে ফেলে, অন্যদিকে নিজেরাই নিজেদের ধ্বংসের পথে পা বাড়ায়। কিন্তু এ যেন এক দুষ্টচক্র, যেখানে এক দলকে সরিয়ে আরেক দল একইভাবে ক্ষমতায় এসে শোষণ চালাতে থাকে।

গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান ও ক্ষমতার রাজনীতি

গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার কথা বললেই সাধারণ মানুষের মনে আসে স্বাধীনতা ও তাদের অধিকার রক্ষার চিন্তা। কিন্তু বর্তমানকালে গণতন্ত্রের নামে যে অভ্যুত্থান আমরা দেখি, তার মূল উদ্দেশ্য প্রায়ই হয় ক্ষমতার দখল। ভোটের মাধ্যমে পরিবর্তন আসে ঠিকই, তবে তা কখনো সাধারণ মানুষের প্রত্যাশিত মুক্তি এনে দিতে পারে না। বরং এটি এক দলকে ক্ষমতায় এনে আরেক দলকে সরিয়ে ফেলে, যার ফলে প্রকৃত সমস্যাগুলো অমীমাংসিত থেকে যায়।

রাজনীতির এই দুষ্টচক্রে আমরা দেখতে পাই, গণতান্ত্রিক অভ্যুত্থান শব্দটি কতটা অর্থহীন হয়ে পড়েছে। কারণ সাধারণ মানুষ প্রতিবারই আশা করে যে, ক্ষমতার পরিবর্তনে তাদের জীবনে সুবিচার ও উন্নতি আসবে। কিন্তু বাস্তবে তারা দেখতে পায় যে, নতুন ক্ষমতাধর গোষ্ঠীও আগের গোষ্ঠীর মতোই তাদের অধিকার ও স্বাধীনতাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে ব্যর্থ। এর ফলে জনগণ ক্রমশ শোষিত ও নির্যাতিত হতে থাকে এবং একসময় রাজনৈতিক ব্যবস্থার প্রতি তাদের আস্থা হারায়। এটি একটি ভয়ানক প্রক্রিয়া যেখানে কেবল ক্ষমতালোভীরা লাভবান হয়।

ইসলামের আলোকে নেতৃত্বের প্রয়োজনীয়তা

ইসলামের মূল শিক্ষা হলো তাওহীদ, অর্থাৎ এক আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস। তাওহীদের মূল ভিত্তিতেই একজন নেতা তার প্রজাদের প্রতি ন্যায়বিচার ও সুরক্ষা দিতে সক্ষম হন। আজকের সমাজে এই জুলকারনাইনের মত নেতৃত্ব প্রয়োজন, যারা সঠিক পথে থেকে সমাজের উন্নয়ন করতে পারে এবং জনগণের মৌলিক অধিকার রক্ষা করতে পারে।

সমাজে নিরাপত্তা ও সুরক্ষার জন্য লৌহ প্রাচীরের আদর্শ

কুরআনে জুলকারনাইন ও ইয়াজুজ-মা'জুজের প্রসঙ্গ নিয়ে এসেছে। কাহিনীতে বলা হয়েছে, ইয়াজুজ-মা'জুজ এমন এক গোষ্ঠী যারা সমাজে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিল। তারা দুর্বল সমাজকে আক্রমণ ও ধ্বংস করার চেষ্টা করেছিল। এই পরিস্থিতিতে জুলকারনাইন একটি লৌহ প্রাচীর তৈরি করে তাদেরকে বাধা দেন। এই প্রাচীর সমাজকে সুরক্ষিত রাখতে সহায়ক ছিল এবং মানুষের জন্য একটি নিরাপদ পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।

লৌহ প্রাচীরকে বর্তমান সমাজের প্রেক্ষাপটে প্রতীকী অর্থে একটি নিরাপত্তার ঘেরাও বা ইসলামী সমাজের আদর্শিক কাঠামো হিসেবে দেখা যেতে পারে। আজকের সময়ে এমন প্রাচীরের প্রয়োজন, যা আমাদের মূল্যবোধ, ইসলামিক নীতি ও বিশ্বাসকে রক্ষা করবে। এমন একটি কাঠামো প্রয়োজন যা আমাদের সমাজকে রক্ষা করবে অপসংস্কৃতি ও বিভ্রান্তিকর আদর্শ থেকে।

আসহাবুল কাহাফের ঘুমন্ত সমাজ

বর্তমান মুসলিম সমাজের অবস্থা যেন আসহাবুল কাহাফ বা গুহাবাসীর মতো একটি ঘুমন্ত অবস্থার সাথে তুলনীয়। আসহাবুল কাহাফ ছিলেন এমন কিছু যুবক, যারা তাদের সমাজের অপসংস্কৃতি ও আল্লাহর প্রতি অবাধ্যতার কারণে একটি গুহায় আশ্রয় নিয়েছিলেন এবং তাদের দীর্ঘ সময়ের জন্য ঘুমন্ত অবস্থায় রাখা হয়েছিল। আমাদের সমাজও যেন এক দীর্ঘ ঘুমে আচ্ছন্ন রয়েছে, যেখানে তাওহীদের মূল আদর্শ বিস্মৃতির আড়ালে পড়ে আছে।

আমাদের বর্তমান সমাজে অনেকেই এই ঘুমন্ত অবস্থায় আছে এবং এই ঘুমন্ত সমাজকে জাগ্রত করার জন্য প্রয়োজন একটি সঠিক আদর্শ, তাওহীদের উপর ভিত্তি করে একটি সুশৃঙ্খল বিপ্লব। এই ঘুমন্ত সমাজের জাগরণ প্রয়োজন, যাতে আমরা পুনরায় ইসলামের সঠিক শিক্ষার উপর ভিত্তি করে একটি শক্তিশালী এবং আদর্শ সমাজ গড়ে তুলতে পারি।

ইসলামী পুনর্জাগরণ এবং শক্তিশালী সমাজ বিনির্মাণ

ইসলামী চেতনার পুনর্জাগরণ আজকের সমাজে অত্যন্ত জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। একটি আদর্শ সমাজ গঠনে ইসলামের মূল শিক্ষাগুলোকে মানুষের মধ্যে পৌঁছানো এবং সমাজের ভিত্তি হিসেবে তাওহীদের ধারণাকে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত করা প্রয়োজন।

ইসলামের মৌলিক শিক্ষা হল এক আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস রাখা এবং তার পথে পরিচালিত হওয়া। এক্ষেত্রে তাওহীদপন্থী নেতৃত্বের অধীনে একটি আদর্শ সমাজ গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন নেতৃত্বের বিকাশ, সমাজের পুনর্গঠন, এবং ইসলামী শিক্ষার প্রসার। সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে তাওহীদের ধারণা বুঝানো এবং তাদের ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত করা এই পুনর্জাগরণের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

আজকের দুনিয়ায় রাজনৈতিক ক্ষমতার দুষ্টচক্র থেকে বেরিয়ে আসতে হলে আমাদের তাওহীদপন্থী আদর্শিক বিপ্লবের প্রয়োজন। জুলকারনাইন ও লৌহ প্রাচীরের আদর্শকে সামনে রেখে আমরা একটি নিরাপদ সমাজ গঠন করতে পারি। আমাদের উচিত এই দুষ্টচক্রের শিকল ভেঙে ইসলামের সঠিক পথে ফিরে আসা, যাতে আমাদের সমাজ প্রকৃতপক্ষে ন্যায়, সুরক্ষা ও শান্তির পথে পরিচালিত হতে পারে। এটি কেবল আমাদের ধর্মীয় দায়িত্ব নয়, বরং আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি সুন্দর সমাজের ভিত্তি গড়ারও দায়িত্ব।


Thanks For Comment we are reply soon as possible.

Previous Post Next Post