✍️ দেলোয়ার হোসেন
আজকের ডিজিটাল বিশ্বে সবচেয়ে শক্তিশালী প্ল্যাটফর্মগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো সোশ্যাল মিডিয়া। এখানে প্রত্যেকেই নিজের মত প্রকাশ করতে পারে, চিন্তা ছড়াতে পারে, এমনকি সমাজ গঠনের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু এ বাস্তবতা আর একমুখী নেই — আজকাল এই প্ল্যাটফর্মগুলো ভাইরাল হওয়ার নামে যেন এক ভয়ঙ্কর ভাইরাসে সংক্রমিত হয়ে পড়েছে।
মানুষ এখন ভাইরাল হতে চায়। নাম করতে চায়, পরিচিত হতে চায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো — কিসের বিনিময়ে? কয়েক সেকেন্ডের জনপ্রিয়তার মোহে আজ অনেকে হারিয়ে ফেলছেন আত্মমর্যাদা, নৈতিকতা, মূল্যবোধ — সব কিছু। এমনকি সমাজের জ্ঞানী-গুণী মানুষেরাও এই ভাইরাল স্রোতে গা ভাসিয়ে দিচ্ছেন এমনসব কনটেন্টের ভেতর, যা দেখে হতবাক হতে হয়।
📉 ভাইরাল হওয়ার নামে মানহীন কনটেন্টের জোয়ার
পৃথিবীতে সব কিছুরই একটা গুণমান থাকা দরকার। কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে, কনটেন্ট মানেই যেন সস্তা হাস্যরস, অশ্লীলতা, কিংবা নিছক নজর কাড়ার জন্য বানানো নাটকীয় কিছু দৃশ্য। সামাজিক শিক্ষা, চিন্তার উৎকর্ষতা, মূল্যবোধের শিক্ষা — এসব যেন আজ লুপ্তপ্রায়।
‘ভিউ’, ‘লাইক’, ‘শেয়ার’ — এই তিনটি শব্দই এখন সমাজের অনেক মানুষের জীবনের মূল উদ্দেশ্যে পরিণত হয়েছে। তারা ভাবেন না, এ কনটেন্টটি দেখে কার কী উপকার হচ্ছে? তারা বিবেচনা করেন না, নিজের সন্তান, ভাই-বোন কিংবা ছাত্ররা যদি এ ভিডিও দেখে — তাহলে কী শিখবে?
🎭 সেলিব্রেটি হবার অন্ধ দৌড়
ভাইরাল হওয়ার নেশা শুধু তরুণদের মধ্যেই নয়, আজ সমাজের বয়োজ্যেষ্ঠ, সম্মানিত, শিক্ষিত ব্যক্তিদেরও গ্রাস করছে। অনেকেই সামাজিক অবস্থান, পেশাগত মর্যাদা ভুলে গিয়ে এমন কনটেন্ট বানাচ্ছেন যা তার ব্যক্তিত্ব ও ভাবমূর্তিকে অসম্মানিত করছে।
এই প্রতিযোগিতা এখন যেন পবিত্র কিছু মানদণ্ডকে চূর্ণ করে দিয়েছে — এখন আর গুণ নয়, প্রয়োজন ‘ট্রেন্ড’। এখন আর বোধ নয়, প্রয়োজন ‘মন্তব্য’। এখন আর সমাজ উন্নয়ন নয়, প্রয়োজন ‘ফলোয়ার’ বাড়ানো।
📣 প্রশ্ন একটাই — আপনার কনটেন্ট সমাজের কী উপকার করছে?
সোশ্যাল মিডিয়ায় ভিডিও বানানো বা কনটেন্ট তৈরি করা খারাপ কিছু নয়। বরং এটি হতে পারে এক অসাধারণ শক্তিশালী মাধ্যম — মানুষের চিন্তা পাল্টানোর, শিক্ষার আলো ছড়িয়ে দেওয়ার, সমাজের কুসংস্কার দূর করার। কিন্তু সেজন্য প্রয়োজন দায়িত্বশীলতা।
ভেবে দেখুন — কেউ যদি আপনার ভিডিওটি দেখে, সে সময় দিচ্ছে। সেই সময়ের কী মূল্য? আপনি যদি তাকে কিছু না শিখাতে পারেন, বরং সময় অপচয় করিয়ে দেন, তবে তার ক্ষতির দায়ভার আপনার ওপরও পড়ে না কি?
✅ গঠনমূলক কনটেন্টই পারে সমাজ বদলাতে
আমরা যদি সত্যিই সমাজকে পরিবর্তন করতে চাই, তবে আমাদের কনটেন্টকে বদলাতে হবে। আমরা যদি চেয়েছি শিক্ষার আলো পৌঁছাতে, তাহলে কনটেন্টে থাকতে হবে শিক্ষা। আমরা যদি সমাজে সচেতনতা গড়ে তুলতে চাই, তাহলে কনটেন্টে থাকতে হবে সত্য, বাস্তবতা, যুক্তি।
একজন কনটেন্ট ক্রিয়েটর হিসেবে আমাদের দায়িত্ব রয়েছে — এমন কিছু বানানো যা দর্শককে চিন্তা করতে শেখাবে, নিজেকে প্রশ্ন করতে শেখাবে, ভুল থেকে ফিরে আসতে শেখাবে। কারণ সমাজ তখনই বদলাবে, যখন চিন্তার ধারা বদলাবে।
❗ সম্মানিতদের দায়িত্ব আরও বেশি
সমস্যার মূল আরেকটি জায়গায় লুকিয়ে আছে। আজ যারা সমাজের আদর্শ, যাদের কথা মানুষ গুরুত্ব দিয়ে শোনে — তারাও যখন অশ্লীল ও হাস্যকর কনটেন্টে যুক্ত হন, তখন সমাজে একটি ভুল বার্তা ছড়ায়। তখনই সাধারণ মানুষ ভাবতে শেখে, “এইসবই স্বাভাবিক”।
এই চিন্তাধারা থেকেই জন্ম নেয় এক বিকৃত সংস্কৃতি। শিক্ষণীয় কনটেন্টের জায়গা দখল করে নেয় নিছক হাসির খোরাক। ফলাফল — চিন্তাশক্তি লোপ পায়, বুদ্ধিবৃত্তিক আলোচনা হ্রাস পায়, সমাজ মেরুদণ্ডহীন হয়ে পড়ে।
🛑 সময় এখনই — দায়িত্বশীল হোন
এই ভাইরাল হওয়ার ভাইরাস থেকে মুক্তির জন্য আমাদের এখনই উদ্যোগ নিতে হবে। আমরা যদি নিজের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করি, তবে সমাজে পরিবর্তন আসবেই। যারা কনটেন্ট তৈরি করেন, তারা ভাবুন — আপনি কী দিচ্ছেন সমাজকে?
🔹 ভালো কিছু বলুন
🔹 ভালো কিছু শেখান
🔹 মানুষের চিন্তায় আলো জ্বালান
এটাই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা।
ভাইরাল হওয়া খারাপ নয়, কিন্তু কীভাবে ভাইরাল হচ্ছেন সেটাই আসল। একটা সময়ের জন্য পরিচিত হয়ে গিয়ে যদি সমাজের জন্য আপনি ক্ষতিকর হয়ে যান — তবে সেই জনপ্রিয়তা অভিশাপে পরিণত হয়।
তাই আসুন, আমরা ভাইরাল হওয়ার চেয়ে মূল্যবান হওয়ার দিকে মনোযোগ দিই। যেন আমরা গর্ব করে বলতে পারি — “হ্যাঁ, আমি কনটেন্ট বানাই। কিন্তু সেটা মানুষের জন্য, সমাজের জন্য।”
🟩 আপনার কনটেন্টে যদি মূল্য থাকে, সময় একদিন আপনাকে ভাইরাল করবেই।