শিক্ষার প্রাথমিক ধারণা:
ইসলামে শিক্ষা একটি মৌলিক বিষয় এবং এর আদি শিক্ষক হলেন স্বয়ং আল্লাহ তাআলা।
ফেরেশতারা বলেছিলেন, “হে আল্লাহ, আপনি
পবিত্র! আপনি যা শিখিয়েছেন, তা ছাড়া আমাদের আর কোনো জ্ঞান নেই; নিশ্চয়ই আপনি
মহাজ্ঞানী ও কৌশলী।” (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ৩২)।
শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের মাধ্যম:
শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের অন্যতম মাধ্যম হলো পঠন-পাঠন। আমাদের প্রিয় নবী (সা.)–এর প্রতি ওহির প্রথম নির্দেশ ছিল, “পড়ো, তোমার রবের নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন,
সৃষ্টি করেছেন 'আলাক' থেকে। পড়ো, তোমার রব মহা সম্মানিত, যিনি শিক্ষাদান করেছেন
লেখনীর মাধ্যমে। শিখিয়েছেন মানুষকে, যা তারা জানত না।” (সুরা-৯৬ আলাক,
আয়াত: ১-৫)।
ইসলামী শিক্ষার মূল পাঠ্যগ্রন্থ:
ইসলামি শিক্ষায় অধ্যয়ন ও অধ্যাপনার মূল পাঠ্যগ্রন্থ হলো আল–কোরআন। আল্লাহ বলেন, “দয়াময় রহমান (আল্লাহ)! কোরআন শেখাবেন বলে
মানব সৃষ্টি করলেন; তাকে বর্ণনা শেখালেন।” (সুরা-৫৫ রহমান, আয়াত: ১-৪)।
শিক্ষার উদ্দেশ্য:
কর্মে ও আচরণে ইতিবাচক পরিবর্তন ও উন্নয়ন সাধন নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে তথ্য প্রদান বা
জ্ঞানদান করাকে শিক্ষাদান বা পাঠদান বলে। খলিফা হজরত উমর (রা.)–এর এক প্রশ্নের জবাবে হজরত উবায় ইবনে
কাআব (রা.) বলেন, “ইলম হলো তিনটি বিষয়,
আয়াতে মুহকামাহ (কোরআন), প্রতিষ্ঠিত সুন্নাত (হাদিস) ও ন্যায় বিধান (ফিকাহ)।”
(তিরমিজি)। তিনি আরো বলেন, “শিক্ষিত
তিনি, যিনি শিক্ষানুযায়ী কর্ম করেন অর্থাৎ শিক্ষার সঙ্গে দীক্ষাও থাকে।”
(তিরমিজি ও আবু দাউদ)।
ইলম বা জ্ঞানের প্রকারভেদ:
ইলম বা জ্ঞান হলো মালুমাত বা ইত্তিলাআত তথা তথ্যাবলি। এটি দুইভাবে অর্জিত হতে
পারে:
1.
ইন্দ্রিয়জ জ্ঞান:
চক্ষু, কর্ণ, নাসিকা, জিহ্বা ও ত্বক (পঞ্চইন্দ্রিয়) মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞান, যা
'ইলমে কাছবি' বা অর্জিত জ্ঞান বলে পরিচিত।
2.
ওহির জ্ঞান:
কোরআন ও সুন্নাহর মাধ্যমে প্রাপ্ত জ্ঞান, যা 'ইলমুল ওয়াহি' বা ওহির জ্ঞান বলে।
ইন্দ্রিয়লব্ধ জ্ঞান সদা পরিবর্তনশীল, কিন্তু ওহির জ্ঞান অপরিবর্তনীয়।
নবী-রাসুলদের শিক্ষার মূল উদ্দেশ্য:
নবী–রাসুলদের
দাওয়াতি কাজের মূল ভিত্তি ছিল জ্ঞানের আলো দিয়ে মানুষকে অন্ধকার থেকে আলোতে নিয়ে
আসা। হজরত ইব্রাহিম (আ.) দোয়া করেছিলেন: “হে
আমাদের প্রভু! আপনি তাদের মাঝে এমন রাসুল পাঠান, যিনি তাদের সমীপে আপনার আয়াত
উপস্থাপন করবেন, কিতাব ও হেকমত শিক্ষা দেবেন এবং তাদের পবিত্র করবেন। নিশ্চয়ই আপনি
পরাক্রমশালী স্নেহশীল ও কৌশলী।” (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১২৯)।
শিক্ষার প্রকৃত উদ্দেশ্য:
বিদ্যা মানে জ্ঞান, শিক্ষা মানে আচরণে পরিবর্তন। সব শিক্ষাই বিদ্যা কিন্তু সব
বিদ্যা শিক্ষা নয়; যদি তা কার্যকরী বা বাস্তবায়ন করা না হয়। জ্ঞান যেকোনো মাধ্যমেই
অর্জন করা যায়, কিন্তু অধ্যয়ন তথা জ্ঞানচর্চা বা বিদ্যার্জন সব সময় শিক্ষার
সমার্থক নয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে শিক্ষার উদ্দেশ্য:
ইসলামে শিক্ষার উদ্দেশ্য হলো আদম সন্তানকে মানুষরূপে গড়ে তোলা। যে শিক্ষা
আত্মপরিচয় দান করে, মানুষকে সৎ ও সুনাগরিক হিসেবে গঠন করে এবং পরোপকারী,
কল্যাণকামী ও আল্লাহর প্রতি অনুরাগী হতে সাহায্য করে, সে শিক্ষাই প্রকৃত শিক্ষা।
শিক্ষা মানুষের অন্তরকে আলোকিত করে, অন্তর্দৃষ্টি উন্মোচিত করে, দূরদর্শিতা সৃষ্টি
করে। আল্লাহ তাআলা বাবা আদম (আ.) কে সৃষ্টি করে প্রথমে তাঁর শিক্ষাব্যবস্থা করলেন।
কোরআনের বর্ণনায়, “আর আল্লাহ তাআলা
আদমকে সকল বস্তুর পরিণতি শেখালেন।” (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ৩১)। যে জ্ঞানের
মাধ্যমে মানুষের অন্তর হিংসা, বিদ্বেষ ও ঘৃণা থেকে মুক্ত হয়ে ভালোবাসায় পরিপূর্ণ
হয়, তা–ই ইসলামি
শিক্ষা।
রাসুলুল্লাহ (সা.)–এর শিক্ষাদান:
রাসুলুল্লাহ (সা.)–কে স্বয়ং
আল্লাহ রাব্বুল আলামিন শিক্ষাদান করেছেন। তিনি বলেন, “আমার রব আমাকে তালিম দিয়েছেন, তা কতই–না উত্তম শিক্ষা এবং আমার রব আমাকে তারবিয়াত করেছেন,
তা কতই না শ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষণ।” (মুসনাদে আহমাদ)। মূলত
শিক্ষা হলো আত্মজ্ঞান বা আত্মোপলব্ধি। শিক্ষিত মানুষ বিনীত ও নিরহংকার হয়ে থাকেন।
শুধু ভাষা জ্ঞান, বর্ণ জ্ঞান বা বিষয় জ্ঞানের নাম শিক্ষা নয়। প্রিয় নবী হজরত
মুহাম্মদ (সা.)–এর অক্ষরজ্ঞান
ও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকলেও ওহির শিক্ষায় আলোকিত হয়ে তিনি হয়েছেন
বিশ্ব-শিক্ষক।
প্রকৃত শিক্ষার মাপকাঠি:
যে শিক্ষা মানুষের কল্যাণে আসে না, তা শিক্ষা নয়। যে শিক্ষা দুনিয়ার শান্তি ও
পরকালে মুক্তির সহায়ক, তাই প্রকৃত শিক্ষা। ইসলামি শিক্ষার প্রতিপাদ্য বিষয় হলো
বিশ্বভ্রাতৃত্ব, মানবকল্যাণ, ত্যাগ ও বিনয়। যদি কোনো শিক্ষা হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা
ও অহংকার উদ্রেক করে, সে শিক্ষা মূর্খতা ও অজ্ঞতা ছাড়া কিছুই নয়। সমাজে শান্তি,
শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা রক্ষায় মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন এবং আদর্শ গুণাবলিসম্পন্ন
ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তৈরি করাই ইসলামি শিক্ষার উদ্দেশ্য।