বিউটিফুল ইসলাম, পর্ব ৯ : ইসলামে জ্ঞান ও বিজ্ঞান

ইসলাম জ্ঞান ও বিজ্ঞানকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছে। ইসলামের প্রাথমিক যুগ থেকে শুরু করে আধুনিক যুগ পর্যন্ত মুসলমানরা জ্ঞানার্জন ও বিজ্ঞানচর্চায় অনন্য ভূমিকা পালন করেছে। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.)-এর প্রথম প্রকাশিত ওহী ছিল “পড়”, যা মুসলিমদের জন্য জ্ঞান অন্বেষণের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশনা হিসাবে বিবেচিত হয়। কুরআন ও সুন্নাহর নির্দেশনা মেনে মুসলিমরা জ্ঞানার্জনকে তাদের ধর্মীয় দায়িত্ব মনে করত এবং সেই দায়িত্ব পালন করেই তারা বিশ্বের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেছে।

প্রাথমিক যুগে জ্ঞান ও শিক্ষা

ইসলামের প্রথম দিন থেকেই জ্ঞান এবং শিক্ষার উপর বিশেষ গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ (সা.) শুধু ধর্মীয় বিষয়ের উপরই নয়, বরং মানব জীবনের সবক্ষেত্রেই জ্ঞান অর্জন করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন। তাঁর নির্দেশনায় সাহাবীগণ এবং পরবর্তী মুসলিম সম্প্রদায় বিজ্ঞান, চিকিৎসা, গণিত, জ্যোতির্বিজ্ঞানসহ বিভিন্ন শাস্ত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছে। ইসলামী শিক্ষার কেন্দ্রবিন্দু ছিল মসজিদ, যেখানে ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয়েও পড়ানো হতো। এভাবে মুসলমানদের মধ্যে জ্ঞান অর্জনের প্রতি এক ধরণের আগ্রহ এবং প্রেরণা সৃষ্টি হয়।

কুরআনের বিজ্ঞানমূলক নির্দেশনা

কুরআন নিজেই বিজ্ঞান ও গবেষণার প্রতি উদ্বুদ্ধ করেছে। সূরা বাকারার ৩১ নং আয়াতে বলা হয়েছে, “অতঃপর আল্লাহ আদমকে সব জিনিসের নাম শেখালেন।” এই আয়াতটি মানবজাতির জ্ঞানার্জনের গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আলোকপাত করে। কুরআনের বিভিন্ন আয়াতে প্রকৃতি, মহাকাশ, প্রাণিজগত এবং অন্যান্য বিষয়ে গবেষণা করতে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। যেমন, সূরা আল ইমরান, আয়াত ১৯০-১৯১ এ বলা হয়েছে, “নিশ্চয়ই আকাশমন্ডল ও পৃথিবীর সৃষ্টিতে এবং রাত-দিনের পরিবর্তনে জ্ঞানবানদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।” এই নির্দেশনা অনুসারে মুসলমানরা কুরআনের আলোকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির বিভিন্ন শাখায় গবেষণা করেছে এবং অগ্রগতি সাধন করেছে।

প্রাচীন যুগের মুসলিম বিজ্ঞানীদের অবদান

প্রাচীন যুগের মুসলিম বিজ্ঞানীরা তাদের অসামান্য গবেষণা এবং আবিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্বকে নতুন দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। রসায়ন শাস্ত্রে জাবির ইবনে হাইয়ানের অবদান উল্লেখযোগ্য। তাঁকে আধুনিক রসায়নের জনক বলা হয়। জাবির প্রায় দুই হাজারেরও অধিক গ্রন্থ রচনা করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে ‘আলকেমি’, যা পরবর্তীতে কেমিস্ট্রি নামে পরিচিত হয়।

চিকিৎসাবিজ্ঞানে ইবনে সিনার অবদানও অতুলনীয়। তিনি সর্বপ্রথম ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি সম্পর্কে গ্রন্থ রচনা করেন এবং মানসিক স্বাস্থ্য ও শারীরিক ব্যবস্থার মধ্যে যোগসূত্র সম্পর্কে আলোকপাত করেন। তার রচিত ‘কানুন ফিত তিবব’ বইটি চিকিৎসাশাস্ত্রে একটি অমূল্য সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হয়।

পদার্থবিজ্ঞান এবং গণিতেও মুসলিম বিজ্ঞানীরা অসামান্য অবদান রেখেছেন। হাসান ইবনে হাইসম সর্বপ্রথম আধুনিক অপটিকস সম্পর্কে ধারণা প্রদান করেন। আল খারিযমী বীজগণিতের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন এবং তার রচিত গ্রন্থটি প্রায় আট শতাব্দী ধরে ইউরোপের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ানো হতো।

মুসলিম বিজ্ঞানীদের হারিয়ে যাওয়া গৌরব

ইসলামের বিজ্ঞানচর্চা এবং গবেষণার এই স্বর্ণযুগ ধীরে ধীরে ক্ষীণ হয়ে আসে। স্পেনে মুসলমানদের পতনের পর হাজার হাজার গ্রন্থাগার ধ্বংস হয়ে যায় এবং মুসলিম বিজ্ঞানীদের হত্যাকাণ্ডের ফলে বিজ্ঞানের সেই প্রদীপ নিভে যায়। যদিও মুসলিমরা বিজ্ঞানচর্চায় এক সময় নেতৃত্ব দিয়েছিল, কিন্তু ইসলামী বিশ্ব ক্রমে প্রতিকূলতার সম্মুখীন হয়। আধুনিককালে পশ্চিমা সভ্যতা বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে নেতৃত্ব দিচ্ছে, কিন্তু তাদের এই অগ্রগতির মূলে রয়েছে মুসলিম বিজ্ঞানীদের গবেষণা।

জ্ঞানচর্চার পুনর্জাগরণ

আজকের মুসলিম সমাজে জ্ঞানচর্চার প্রয়োজনীয়তা আরও বেশি। মসজিদে সীমাবদ্ধ না থেকে মুসলিমদের উচিত বিজ্ঞান, প্রযুক্তি, চিকিৎসাবিজ্ঞান, এবং অন্যান্য শাস্ত্রে নিজেদের অগ্রগামী করে তোলা। মুসলিম মনীষীদের গৌরবময় ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে, বর্তমান প্রজন্মকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নতুন সাফল্য অর্জন করতে হবে। মুসলমানদের জ্ঞানচর্চা শুধু ধর্মীয় দায়িত্বই নয়, বরং এটি সামাজিক এবং অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য অপরিহার্য।

ইসলাম জ্ঞান এবং বিজ্ঞানকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে এবং প্রাচীন যুগের মুসলিম বিজ্ঞানীরা এই শিক্ষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে বিশ্বকে নতুন দিশা দেখিয়েছে। ইসলামী শিক্ষার মর্মবাণী অনুসরণ করে, বর্তমান মুসলিম সমাজকেও বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তিতে অগ্রসর হতে হবে। এজন্য প্রয়োজন ইসলামের সোনালী যুগের বিজ্ঞানী ও গবেষকদের অবদানকে স্মরণ করা এবং সেই জ্ঞানকে আবারও জাগ্রত করা।

Thanks For Comment we are reply soon as possible.

Previous Post Next Post