গত ১৫ থেকে ১৬ বছরে বাংলাদেশে জামায়াত-শিবির কর্মীদের জীবনের নিরাপত্তা চরম হুমকির মুখে ছিল। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক নানা প্রতিকূলতার কারণে তারা নিজেদের পরিচয় গোপন করতে বাধ্য হয়েছিল। সেই সময়ে, এমনকি এখনো অনেক ক্ষেত্রে, জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের জন্য নির্যাতন, নিপীড়ন এবং এমনকি মৃত্যুর সম্মুখীন হয়েছেন। রাষ্ট্রীয়ভাবে বৈধভাবে পরিচালিত হত্যাযজ্ঞের শিকার হয়ে, তাদের জীবনের মূল্যকে অবমূল্যায়ন করা হয়েছে। এই প্রশ্নই আজ উঠেছে, কেন জামায়াত-শিবির পরিচয় গোপন করলো এবং কীভাবে রাজনৈতিক কৌশল তাদের জন্য অপরিহার্য হয়ে উঠেছিল?
শিবির কেন পরিচয় গোপন করলো?
জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের ওপর ক্রমাগতভাবে রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক হামলা শুরু হয় গত ১৫-১৬ বছরে। এ ধরনের হামলা ছিল পরিকল্পিত, এবং অনেকক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় সমর্থনপ্রাপ্ত। জামায়াত ও শিবিরের কর্মীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করার জন্য এই নির্যাতন চালানো হয়েছে। একদিকে রাষ্ট্রীয় ফ্যাসিবাদী শক্তি, অন্যদিকে মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীদের হামলা শিবিরের কর্মীদের জীবনকে চরম ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছিল। এই পরিস্থিতিতে, নিজেদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে তারা পরিচয় গোপন করতে বাধ্য হয়। কারণ, পরিচয় প্রকাশ মানে তাদের জীবনের জন্য আরও হুমকি তৈরি হওয়া।
কোনো রাজনৈতিক দলের কর্মী যদি তার রাজনৈতিক পরিচয় প্রকাশ করতে ভয় পায়, তবে সেই পরিস্থিতির ভয়াবহতা সহজেই বোঝা যায়। একসময়ের গণতান্ত্রিক সমাজ যেখানে রাজনৈতিক বিশ্বাস প্রকাশের অধিকার ছিল মৌলিক অধিকার, সেই সমাজে শিবিরের কর্মীরা তাদের পরিচয় লুকিয়ে রাখতে বাধ্য হয়েছে। তাদের পরিচয় জানানো মানে ছিল জীবনের ঝুঁকি নেওয়া, এবং সেই ঝুঁকির দায় কেউ নিতে চায়নি।
রাষ্ট্রীয় বৈধতা দিয়ে হত্যা
ফ্যাসিস্ট সরকার জামায়াত-শিবিরকে নির্মূল করতে রাষ্ট্রীয়ভাবে সহিংসতার বৈধতা দিয়েছে। জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা শুধুমাত্র তাদের রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে সমাজের অন্যদের মতো সমান সুযোগ সুবিধা পাননি। অনেক ক্ষেত্রে তাদের শিক্ষাজীবন, চাকরির সুযোগ এমনকি সামান্য নিরাপত্তাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। রাষ্ট্র তাদের হত্যা ও নির্যাতনকে বৈধভাবে স্বীকৃতি দিয়েছে, এবং তাদের মদদপুষ্ট সন্ত্রাসীরা এই হামলা চালিয়ে গেছে নিরবচ্ছিন্নভাবে।
একই সময়ে, জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের হত্যার পরও কোনো রাষ্ট্রীয় সহানুভূতি কিংবা ন্যায়বিচার পাওয়া যায়নি। এমনকি দেশের মিডিয়া, বিশেষ করে প্রধান গণমাধ্যমগুলো, এই হত্যাকাণ্ডের পরও তাদের সমর্থন দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনাগুলোকে মিডিয়া বড় করে তুললেও, শিবিরের কর্মীদের প্রতি কোনো সহানুভূতি দেখায়নি। হাফিজুর ভাইয়ের মতো রোগাক্রান্ত কর্মীদের তুলে নিয়ে হত্যার ঘটনায় কোনো সংবাদমাধ্যম সহানুভূতি প্রকাশ করেনি, কারণ তিনি শিবিরের সদস্য ছিলেন।
ফ্যাসিবাদী হামলার প্রতিরোধ
শিবিরের রাজনৈতিক কৌশল ছিল ফ্যাসিবাদের পতনে ভূমিকা রাখা। তারা ফ্যাসিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ না করে, গোপনে সংগঠিত হয়ে রাষ্ট্রীয় দমননীতির বিরোধিতা করেছে। এই সময়ে পরিচয় গোপন রাখা ছিল তাদের কৌশলের অংশ। শিবির জানতো, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে টিকে থাকতে হলে তাদের নিজেদের কৌশল পরিবর্তন করতে হবে। তাদের লক্ষ্য ছিল ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটানো, এবং এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে তারা তাদের রাজনৈতিক পরিচয়কে অগ্রাধিকার না দিয়ে, কৌশলগতভাবে সংগঠিত হয়েছে।
শিবিরকে গণতান্ত্রিক সমাজে স্টিগমাটাইজ করার প্রক্রিয়া
একটি গণতান্ত্রিক সমাজে একটি বৈধ রাজনৈতিক দলকে স্টিগমাটাইজ করা হয় কেন? এই প্রশ্ন আজো উত্তরহীন। শিবিরকে সমাজে এমনভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে, যেন তারা সমাজের মূলধারার বাইরে একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। এই স্টিগমাটাইজেশন প্রক্রিয়া রাষ্ট্র এবং সমাজ উভয়ের সমর্থন পেয়েছে। জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা শুধুমাত্র তাদের রাজনৈতিক পরিচয়ের কারণে চাকরি থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, শিক্ষার সুযোগ হারিয়েছেন এবং তাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে চরম অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছেন।
বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিবিরের কর্মীদের নির্যাতন ছিল অত্যন্ত নির্মম। বুয়েট, কুয়েট, চুয়েট এবং রুয়েটের মতো দেশের শীর্ষস্থানীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো থেকে জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের বের করে দেওয়া হয়েছে, তাদের শিক্ষাজীবন ধ্বংস করা হয়েছে। শুধু এই পরিচয়েই তাদের ভবিষ্যত ধ্বংসের দিকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে।
প্রথম আলোর ভূমিকা ও গাছের জীবনের মূল্য
বাংলাদেশের মূলধারার মিডিয়া, বিশেষ করে প্রথম আলো, শিবিরের কর্মীদের ওপর সহিংসতার ঘটনা নিয়ে চুপ থেকেছে। জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা যখন নির্যাতনের শিকার হয়েছে, তখন প্রথম আলো তাদের জীবনের মূল্যকে গাছের জীবনের চেয়েও কম দেখিয়েছে। রাস্তার গাছ কেটে প্রতিবাদ করায় শিবিরকে নিয়ে মিডিয়ায় বিশদ আলোচনার পরিবর্তে, গাছের জন্য শোক প্রকাশ করা হয়েছে।
প্রথম আলো বা অন্য কোনো মিডিয়ায় শিবিরের কর্মীদের জন্য সহানুভূতি দেখানো হয়নি। অথচ তারা সবসময় রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়েছে। শিবিরের কর্মীদের হত্যাকাণ্ডে গাছের ক্ষতি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ হলেও, তাদের জীবনের জন্য একটি শব্দও উচ্চারিত হয়নি। এটি একটি সমাজের বিকৃত চিত্র যা শিবিরের প্রতি বৈরিতা প্রকাশ করে।
আজকের প্রশ্ন: কেন পরিচয় গোপন?
আজকের প্রেক্ষাপটে একটি মৌলিক প্রশ্ন উঠে আসে, কেন জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা তাদের পরিচয় গোপন করেছে? তাদের পরিচয় গোপন করার প্রধান কারণ ছিল জীবনের ঝুঁকি। একটি গণতান্ত্রিক দেশে যেখানে রাজনৈতিক দলগুলো স্বাধীনভাবে তাদের কর্মকাণ্ড চালানোর কথা, সেখানে একটি দলকে এভাবে চরম নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে। তাদের কণ্ঠ রুদ্ধ করা হয়েছে, তাদের জীবনের অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছে, এবং তারা পরিচয় প্রকাশের পরিবর্তে নিজেদের বাঁচানোর জন্য কৌশল নিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে মূল প্রশ্নটি হওয়া উচিত, কিভাবে আমরা এমন একটি সমাজ গড়লাম যেখানে একটি রাজনৈতিক দলের কর্মীরা জীবনের ভয়ে তাদের পরিচয় প্রকাশ করতে পারেন না? যে সমাজে রাজনৈতিক বিশ্বাসের কারণে মানুষকে হত্যা করা হয়, সেই সমাজ কিভাবে নিজেদের গণতান্ত্রিক দাবি করতে পারে?
ভবিষ্যতের চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের ভবিষ্যত রাজনীতিতে শিবিরের মতো সংগঠনগুলোকে কিভাবে গ্রহণ করা হবে, সেটি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে সবার রাজনৈতিক বিশ্বাসের প্রতি সম্মান দেখানো উচিত। কিন্তু গত ১৫ বছরের অভিজ্ঞতা থেকে আমরা দেখেছি, এই সমাজে শিবিরের জীবন এবং মর্যাদা কোনো গুরুত্ব পায়নি।
ফ্যাসিবাদের পতন ঘটাতে হলে আমাদের সমাজে রাজনৈতিক মতপার্থক্যকে সম্মান করতে হবে। শিবিরের কর্মীদের ওপর যে নির্মমতা চালানো হয়েছে, সেটির পুনরাবৃত্তি আর না হওয়ার জন্য আমাদের শিক্ষাগ্রহণ করতে হবে।
শিবির পরিচয় গোপন করে তাদের রাজনৈতিক কৌশল নিয়েছে, এবং সেই কৌশলের কারণে তারা কিছুটা হলেও টিকে থাকতে পেরেছে। তবে তাদের পরিচয় গোপন করার এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি অন্ধকার অধ্যায় হয়ে থাকবে।