দীর্ঘ ষোল বছরের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন এবং কর্তৃত্ববাদী সরকারের জাঁতাকলে বাংলাদেশের মানুষ চরম নিপীড়ন, শোষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল নির্বিশেষে ফ্যাসিবাদের বিষাক্ত ছোবলে প্রত্যেকটি শ্রেণীর মানুষ কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফ্যাসিবাদী শাসনের মূল ভিত্তি যারা তৈরি করেছিল, তারাও এই অত্যাচার থেকে রেহাই পায়নি—জ্ঞাত কিংবা অজ্ঞাতসারে তারাও ফ্যাসিবাদ দ্বারা ভিক্টিম হয়েছে।
ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রেক্ষাপট ও মানুষের অবস্থা
ফ্যাসিবাদী শাসন বলতে বুঝায় একটি এমন শাসনব্যবস্থা যেখানে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা পুরোপুরি হরণ করা হয়। জনগণের ওপর অসীম ক্ষমতার অধিকারী হয়ে স্বৈরশাসক একনায়কত্বের পতাকা ওড়ায়। বাংলাদেশে এই দীর্ঘ ষোল বছরের ফ্যাসিবাদী শাসনকাল তেমনই একটি নিদারুণ অধ্যায়, যেখানে মানুষ তার ন্যায্য অধিকারগুলো থেকে বঞ্চিত হয়েছে।
ফ্যাসিবাদ শুধু রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ ছিল না; এর শেকড় পোঁতা ছিল সমাজের প্রতিটি স্তরে। গণতন্ত্রের নামে একদলীয় শাসন কায়েম করা হয়েছিল। সরকারি প্রশাসন থেকে বিচার বিভাগ, সংবাদমাধ্যম থেকে শিক্ষাঙ্গন—সবকিছু ছিল নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। ভোটের অধিকার, বাকস্বাধীনতা, এমনকি বিচার পাওয়ার অধিকারও ছিল সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সমাজের উচ্চ পর্যায়ের মানুষও এই শাসন ব্যবস্থার জাঁতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছেন।
নিপীড়িত জনগণের জেগে ওঠা: জুলাই বিপ্লব
ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে জনগণের ক্ষোভ ধীরে ধীরে পুঞ্জীভূত হচ্ছিল। অবশেষে জুলাই মাসে সর্বস্তরের মানুষ একত্রিত হয়ে এক অভূতপূর্ব বিপ্লবের সূচনা করেছিল। এটি ছিল একটি গণবিপ্লব, যেখানে সবাই ছিল এক ছাতার নিচে। নিপীড়িত ও শোষিত মানুষেরা ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে নিজেদের সর্বস্ব বাজি রেখে দাঁড়িয়েছিল।
জুলাই বিপ্লবের চূড়ান্ত মুহূর্তে শহীদরা তাঁদের জীবন কোরবানি করে আমাদের সামনে একটি নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন রেখে গেছেন। তাঁরা সাম্য, মানবতা ও গণতন্ত্রের ভিত্তিতে গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন একটি মুক্ত বাংলাদেশ।
শহীদের আত্মত্যাগ: একটি নতুন দিগন্তের সূচনা
এই বিপ্লবের প্রতিটি ধাপে শহীদেরা ছিলেন অগ্রগামী। শহীদ আবু সাঈদের রক্ত দিয়ে লেখা এই বিপ্লব। শহীদ মীর মুগ্ধের স্মৃতি এই আন্দোলনের পাথেয় হয়ে রয়েছে। যেসব রিকশাচালক, শ্রমিক, দিনমজুর এবং সাধারণ জনগণ নির্ভীকভাবে এই আন্দোলনের অংশ হয়েছেন এবং শহীদ হয়েছেন, তাঁদের কুরবানি বাংলাদেশের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
বাংলাদেশের জনগণ এই ফ্যাসিবাদী শাসনকে প্রতিহত করার জন্য নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়েছেন। তাদের সামনে প্রতিপক্ষ ছিল এক দানবীয় শক্তি, কিন্তু তবুও তারা পিছপা হয়নি। সাহসী সাংবাদিক, সোশ্যাল মিডিয়ার ইনফ্লুয়েন্সার, প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধারা এই বিপ্লবে অবদান রেখেছেন।
গণবিপ্লবের সাফল্য ও ভবিষ্যতের প্রত্যাশা
৩৬শে জুলাইয়ের গণবিপ্লব শুধু একটি রাজনৈতিক বিজয় ছিল না, এটি ছিল জনগণের আত্মমর্যাদার পুনরুদ্ধার। বাংলাদেশের প্রতিটি অঞ্চলের মানুষ এই বিপ্লবে সমানভাবে অবদান রেখেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শুরু করে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল, শাপলা চত্বর থেকে শুরু করে যাত্রাবাড়ির রাস্তায় রক্তের ধারা বয়ে গেছে। শহুরে মধ্যবিত্ত জনগণ থেকে শুরু করে সুবিধাবঞ্চিত মানুষেরাও এ বিপ্লবে অংশগ্রহণ করেছে।
এটি ছিল সমাজের প্রতিটি স্তরের মানুষের যৌথ প্রচেষ্টা। ইংলিশ মিডিয়ামের টেক স্যাভি কিড থেকে শুরু করে কওমি মাদ্রাসার তালেবে এলেম, সব ধরনের মানুষ এই আন্দোলনে অবদান রেখেছে। শহরের উঁচুতলার মানুষ যেমন এতে অংশ নিয়েছেন, তেমনি সমাজের সবচেয়ে নিচু স্তরের মানুষও এতে সমানভাবে ভূমিকা রেখেছে। এই বিপ্লবের সাফল্যের পেছনে রয়েছে হাজার হাজার শহীদের আত্মত্যাগ, যারা নিজেদের জীবন দিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ উপহার দিয়েছেন।
শহীদদের আত্মত্যাগের সম্মান ও আমাদের দায়িত্ব
শহীদদের আত্মত্যাগের সম্মান রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের উপর। তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার জন্য আমাদের একযোগে কাজ করতে হবে। আমাদের লক্ষ্য হবে বৈষম্যহীন, সুখী এবং সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা। এই লক্ষ্য পূরণে আমাদের ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনকে আরও শক্তিশালী করতে হবে এবং সকল শ্রেণীর মানুষকে একত্রিত করতে হবে।
ভবিষ্যতের বাংলাদেশের স্বপ্ন
আমাদের সামনে এখন এক সুদীর্ঘ পথ। ফ্যাসিবাদবিরোধী সংগ্রামের মাধ্যমে আমরা যে বিজয় অর্জন করেছি, তা ধরে রাখতে হলে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। এই বিজয় শুধুমাত্র রাজনৈতিক বা অর্থনৈতিক নয়; এটি একটি সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিজয়। আমাদের লক্ষ্য হবে বৈষম্যহীন, শান্তিপূর্ণ এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
শহীদেরা যে স্বপ্ন দেখে গেছেন, তা পূরণের জন্য আমাদের অবশ্যই ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমাদের প্রত্যেককে দায়িত্ব নিতে হবে এই স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার। শহীদেরা আমাদের সামনে যে আলোকবর্তিকা তুলে ধরেছেন, তা আমাদের পথ দেখাবে।
উপসংহার
ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে দীর্ঘ সংগ্রামের পর আমরা পেয়েছি একটি নতুন বাংলাদেশ—Bangladesh 2.0। এটি একটি স্বাধীন, সার্বভৌম এবং নতুন বাংলাদেশ। আমাদের শহীদেরা তাদের জীবন দিয়ে যে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন, তা ধরে রাখার দায়িত্ব আমাদের সবার।
আল্লাহ আমাদের সকলকে শক্তি দিন যাতে আমরা এই স্বাধীনতা ধরে রাখতে পারি এবং আমাদের শহীদদের আত্মত্যাগ বৃথা না যায়। আমিন।