মাওলানা মওদুদী সাহেবের আকিদা ও তার প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামীর বিরুদ্ধে নানা অপপ্রচার ও ভুল ধারণা ছড়ানো হয়েছে, এ কারণে কিছু মানুষ মওদুদী সাহেব ও তার প্রতিষ্ঠিত জামায়াত সম্পর্কে বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছেন। মাওলানা মওদুদী সাহেবকে নিয়ে যারা নানা রকম ভ্রান্ত ধারণা প্রকাশ করেন, তাদের প্রতি অনুরোধ থাকবে, তার লেখা কিতাবগুলো পড়ুন এবং সেগুলো বিশ্লেষণ করে তবেই মন্তব্য করুন। কোন হুজুর কি বললেন বা কোন বক্তা কী বললেন, সেগুলো যথার্থ দলিল হতে পারে না। প্রকৃত দলিল হলো, তার নিজস্ব লেখা এবং সেই লেখাগুলোর মাধ্যমে তার চিন্তা ও আকিদাকে বোঝা।
মাওলানা মওদুদীর চিন্তাধারা ও আকিদা
মওদুদী সাহেব কোনো নিজস্ব আকিদা তৈরি করেননি বরং ইসলামের প্রাথমিক সূত্র কুরআন ও সুন্নাহের ভিত্তিতে তার চিন্তা ও কার্যক্রম পরিচালিত করেছেন। তিনি ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তার রাজনৈতিক চিন্তার মূল ভিত্তি ছিল ইসলামী নীতি-নৈতিকতা এবং শরিয়াহর আলোকে একটি শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। যারা মওদুদী সাহেবের আকিদা নিয়ে কথা বলেন, তাদের উচিত তার লেখা পড়া এবং তাতে উল্লেখিত দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিষয়গুলো বোঝা।
মওদুদী সাহেবের বিপক্ষে যে অভিযোগগুলো ওঠে, তার অধিকাংশই ভিত্তিহীন এবং প্রমাণবিহীন। তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, বাংলাদেশের অনেক মাদ্রাসায় মওদুদী সাহেবের 'ভ্রান্ত আকিদা' নামে কিছু পাঠ্যপুস্তক রচিত হয়েছে, যেখানে তার বিরুদ্ধে নানা ধরনের ভুল তথ্য ছড়ানো হয়েছে। এসব লেখার সাথে কোনো নির্দিষ্ট দলিল বা তার কিতাব থেকে প্রমাণ সন্নিবেশিত নেই। তাই, এসব অভিযোগ যাচাই করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা, সত্যকে মিথ্যার আড়ালে রেখে কারো আকিদা সম্পর্কে ভুল বোঝার কোনো যৌক্তিকতা নেই।
জামায়াতে ইসলামী: একটি সুশৃঙ্খল দল
জামায়াতে ইসলামী একটি সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খল দল, যা ইসলামী আদর্শে পরিচালিত। জামায়াতকে কেউ পছন্দ না করতে পারেন, কিন্তু তাদের মতো সুসংগঠিত, কার্যকর এবং সুশৃঙ্খল একটি দল তৈরি করতে অন্য ইসলামী দলগুলোর এখনো ৫০ বছর সময় লাগতে পারে। একটি দেশ পরিচালনার জন্য যে সমন্বিত শিক্ষা, অর্থনৈতিক শক্তি, এবং বৈজ্ঞানিক মনোভাব প্রয়োজন, সেসব দিক থেকে জামায়াতে ইসলামী অনেকদূর এগিয়ে রয়েছে।
জামায়াতে ইসলামী শুধুমাত্র একটি রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি আদর্শিক দল যা কেবল ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করে না বরং ইসলামী নীতি ও আদর্শকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করতে কাজ করে। এই দলে এমন ব্যক্তিরাই যুক্ত, যারা ইসলামের মূলনীতি ও আদর্শকে আঁকড়ে ধরে আছেন এবং তাদের নেতৃত্বে জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনতে চান। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে জামায়াতই একমাত্র দল যাদের রয়েছে সুসংগঠিত কাঠামো এবং সারা দেশে একটি কার্যকর নেটওয়ার্ক।
ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে বিভেদ দূর করা জরুরি
অন্যান্য ইসলামী দলগুলো আওয়ামী লীগ বা অন্য কোনো দলের সাথে জোট গড়তে পারলেও জামায়াতে ইসলামীর সাথে তাদের ঐক্য গড়তে সমস্যা হয়। এর কারণ হলো, জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান ও আদর্শ অন্যদের থেকে স্বতন্ত্র এবং কিছু দল মনে করে জামায়াত তাদের সাথে বড় ভাইয়ের মতো আচরণ করবে। তবে প্রশ্ন হলো, এটা কি ইসলামের শিক্ষা? ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে নিজেদের ক্ষুদ্র স্বার্থকে বড় করে দেখা কি ঠিক? ইসলামের দৃষ্টিতে ঐক্য এবং সংহতি সবসময় গুরুত্বপূর্ণ, আর জামায়াতে ইসলামী এমন কোনো কাজ করেনি যার দ্বারা অন্য কোনো দল আক্রান্ত হয়েছে। বরং জামায়াত বরাবরই ইসলামের দাওয়াত এবং ইসলামী শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করে যাচ্ছে।
জামায়াতের আকিদা ও ভুল ধারণা
জামায়াতের আকিদা নিয়ে কিছু লোক প্রায়ই সমালোচনা করে থাকেন। বিশেষ করে, কিছু তথাকথিত আলেম জামায়াতের আকিদাকে ভ্রান্ত বলে প্রচার করেন। সম্প্রতি একটি টকশোতে এমন এক ইসলামী দলের নায়েবে আমির বলেছেন, জামায়াতের আকিদা সংশোধন করতে হবে। কিন্তু যারা এসব অভিযোগ করেন, তাদের উচিত জামায়াতের আকিদা সম্পর্কে স্পষ্টভাবে জানা এবং তারপর মন্তব্য করা।
জামায়াতে ইসলামীর আকিদা সম্পর্কে যদি কোনো বিভ্রান্তি থাকে, তবে তাদের প্রকাশিত সংবিধান ও গঠনতন্ত্র পড়া উচিত। জামায়াতে ইসলামী তার গঠনতন্ত্রে সুস্পষ্টভাবে উল্লেখ করেছে যে, তাদের বুনিয়াদি আকিদা হলো 'লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ'। এই কালেমার মূল বার্তা হলো, আল্লাহই সর্বশক্তিমান, তিনি একমাত্র সার্বভৌম, এবং মুহাম্মদ (সা.) তার রাসূল। জামায়াত স্পষ্ট করে বলেছে, তাদের সকল কার্যক্রম ইসলামী শরিয়াহ অনুযায়ী পরিচালিত হয়, এবং তারা ইসলামী বিধানের বাইরে কিছুই মানে না।
জামায়াতে ইসলামী তাদের আকিদায় বলেছে যে, তারা আল্লাহ ছাড়া কাউকে সার্বভৌমত্বের মালিক মনে করে না এবং আল্লাহ ছাড়া কারো নিকট সাহায্য, দোয়া বা প্রার্থনা চায় না। তারা এটাও বিশ্বাস করে যে, আল্লাহ এবং তার রাসূলের আদেশ-নিষেধ মেনে চলাই একমাত্র সঠিক পথ, এবং অন্য কারো কথা বা আদেশ তাৎপর্যপূর্ণ নয় যদি তা আল্লাহ ও তার রাসূলের সাথে সাংঘর্ষিক হয়।
গণতন্ত্র ও জামায়াতের অবস্থান
অনেকেই মনে করেন, যেহেতু জামায়াতে ইসলামী গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচন করে, তাই তারা গণতন্ত্রের নামে জনগণকে সার্বভৌমত্বের অধিকারী মনে করে। কিন্তু এটা ভুল ধারণা। জামায়াতের মতে, সার্বভৌম ক্ষমতার মালিক একমাত্র আল্লাহ তায়ালা। তবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি একটি সাংগঠনিক উপায় মাত্র, যার মাধ্যমে নেতা নির্বাচন এবং কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর শিখানো শুরা পদ্ধতির মাধ্যমেও কার্যক্রম পরিচালনা হয়। জনগণকে সার্বভৌম মনে করার অভিযোগ ভিত্তিহীন, কারণ জামায়াত কখনোই আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বাইরে কিছু স্বীকার করে না।
যারা জামায়াতের রাজনৈতিক অবস্থানের সমালোচনা করেন, তাদের জেনে রাখা উচিত যে, জামায়াত কখনো ইসলামের নীতি থেকে বিচ্যুত হয়নি। যদিও জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছিল, তবুও তারা তাদের আকিদা বা ইসলামের প্রতি তাদের আনুগত্য নিয়ে কোনো আপোষ করেনি।
শেষ কথা
মাওলানা মওদুদী সাহেব এবং তার প্রতিষ্ঠিত জামায়াতে ইসলামীর আকিদা ও আদর্শ সম্পর্কে যারা সমালোচনা করেন, তাদের উচিত মওদুদী সাহেবের নিজস্ব লেখা এবং জামায়াতের গঠনতন্ত্র পড়ে তবেই মন্তব্য করা। দলিলবিহীন অভিযোগ করে কারো সঠিক অবস্থানকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা কখনোই ইসলাম সম্মত নয়।
জামায়াতে ইসলামী একটি আদর্শিক দল, যারা ইসলামি নীতি মেনে এবং শরিয়াহ অনুযায়ী কাজ করে। তাদের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ তুলে বিভ্রান্তি ছড়ানোর পরিবর্তে তাদের কাজ এবং আকিদাকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করা উচিত। আমরা সবাইকে আহ্বান জানাই, ইসলামের বৃহত্তর স্বার্থে জামায়াতের সাথে একতাবদ্ধ হয়ে কাজ করুন, দ্বীনের পথে সবাই মিলে একসাথে এগিয়ে চলুন।