জামায়াতের অর্থায়ন- সমাজে সেবা ও মানবিক কার্যক্রম

 জামায়াতের অর্থায়ন ও এর সাফল্যের রহস্য নিয়ে আলোচনা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যা বাংলাদেশে রাজনৈতিক দলগুলোর প্রভাব এবং কার্যক্রম সম্পর্কে অনেক প্রশ্ন তোলে। জামায়াতে ইসলামী একটি রাজনৈতিক দল হলেও তাদের অর্থায়নের ধরন ও কৌশল অন্য দলের তুলনায় অনেকটাই আলাদা এবং স্বচ্ছ। আজকের ব্লগটি জামায়াতের টাকার উৎস ও তাদের অর্থ ব্যবস্থাপনার ধরন নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব। 

জামায়াতের টাকার উৎস:

প্রথমেই জামায়াতে ইসলামী কোথা থেকে অর্থ পায়, সে বিষয়ে কথা বলা দরকার। জামায়াতের আয়ের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ আসে তাদের নিজস্ব সদস্যদের থেকে। এই দলের সদস্যরা প্রতিমাসে তাদের আয়ের একটি নির্দিষ্ট অংশ সংগঠনের ফান্ডে জমা দেয়। এটি এক ধরনের চাঁদা বা ‘দান’ হলেও এর মধ্যে একটি সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন রয়েছে। প্রত্যেক সদস্য তার আয়ের ৫ শতাংশ সংগঠনের ফান্ডে জমা দেয়। এ নিয়ম রিক্সাচালক থেকে শুরু করে ব্যবসায়ী সকলের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। যার আয়ের পরিমাণ যেমন, তিনি ততটাই দান করেন। যেমন, একজন রিক্সাচালক 5০ টাকা দিতে পারেন, একজন সচ্চ কর্মী ৫০০/১০০০ টাকা আবার একজন ব্যবসায়ী ৫,০০০ টাকা দিতে পারেন মাসিক বায়তুল মাল হিসাব। 

তাদের অর্থসংগ্রহের প্রক্রিয়াটি খুবই স্বচ্ছ এবং সুসংগঠিত। প্রতিটি ইউনিট, উপজেলা, জেলা এবং কেন্দ্রীয় পর্যায়ে অর্থ সংরক্ষণ ও ব্যয়ের হিসাব-নিকাশ সুনির্দিষ্টভাবে করা হয় এবং নিয়মিত অডিট করা হয়। ফলে ভুলত্রুটি হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে।

সংগঠনের স্তরভিত্তিক অর্থায়ন:

জামায়াতে ইসলামী চারটি স্তরের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহ করে। প্রথমত, সমর্থক এবং কর্মীরা ইচ্ছেমতো টাকা দেন। অগ্রসর কর্মী এবং সদস্যদের ক্ষেত্রে মাসিক আয়ের ৫ শতাংশ দান বাধ্যতামূলক। সংগঠনের প্রতিটি স্তরে অর্থ সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ প্রক্রিয়া রয়েছে। সংগঠন কেন্দ্রের অর্থায়ন ব্যবস্থা নীচ থেকে উপরের দিকে চলে। প্রতিটি ইউনিট তার সুনির্দিষ্ট টার্গেট অনুযায়ী অর্থ সংগ্রহ করে এবং তা উচ্চতর ইউনিটে পাঠিয়ে দেয়। যেমন, একটি ইউনিয়ন ইউনিট উপজেলা বা থানাকে অর্থ পাঠায়, উপজেলা তা জেলা পর্যায়ে দেয়, এবং জেলা তা কেন্দ্রে পাঠায়।

ইসলামী অর্থনীতির ভিত্তি:

জামায়াতের অর্থায়ন কেবল সংগঠনের জন্যই নয়, এর পেছনে ইসলামী অর্থনীতির আদর্শও কাজ করে। ইসলাম মানবতার সেবা এবং সাদাকাহ (দান) প্রদানের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেয়। জামায়াতে ইসলামী এই ধর্মীয় মূলনীতিকে তাদের অর্থ ব্যবস্থাপনার সঙ্গে মিলিয়ে কাজ করে। তারা সংগঠনের সদস্যদের আয় থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ সাদাকাহর উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে। এই প্রক্রিয়াটি মানবতার সেবার সাথে ধর্মীয় দায়িত্ব পালন করারও একটি মাধ্যম। তাদের সদস্যরা যেমন নিজেদের আয়ের একটি অংশ দান করে, তেমনই এই অর্থ দিয়ে সংগঠনটি মানবিক কার্যক্রম চালায়, যেমন শহীদ পরিবারদের সহায়তা, বন্যাদুর্গতদের পাশে দাঁড়ানো ইত্যাদি।

সমাজে জামায়াতের সেবা ও মানবিক কার্যক্রম:

জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক কার্যক্রমের পাশাপাশি সমাজসেবার জন্যও বেশ পরিচিত। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা সংকটময় সময়ে তারা সবার আগে সহায়তা নিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়ায়। এই সকল কাজের জন্য তাদের বিপুল অর্থের প্রয়োজন হয়। যদিও এ নিয়ে অনেকের মনে প্রশ্ন থাকে যে, তাদের এত টাকা কোথা থেকে আসে, তবে বাস্তবে দেখা যায়, তাদের আয়ের বেশিরভাগই আসে সদস্যদের দান থেকে। এছাড়া জামায়াতের নেতাকর্মীরা অনেকেই পেশাজীবী এবং সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি থেকে আসা মানুষ। ফলে তাদের আয়ের পরিমাণও বৈচিত্র্যময় হয়, যা সংগঠনের ফান্ডে একটি শক্ত ভিত্তি গড়ে তোলে।

অর্থনৈতিক স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা:

জামায়াতে ইসলামী তাদের অর্থ ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বেশ স্বচ্ছ ও নিয়মমাফিক কাজ করে। প্রতিটি অর্থ সংগ্রহ এবং ব্যয়ের ক্ষেত্রে রসিদ এবং ভাউচারের মাধ্যমে কাজ করা হয়। প্রতি বছরের বেশ কয়েকবার প্রতিটি ইউনিট এবং কেন্দ্রে অডিট করা হয়, যাতে কোনো ধরনের ভুল বা দুর্নীতি ঘটতে না পারে। এ কারণে জামায়াতের অর্থায়ন ব্যবস্থা খুবই সুনির্দিষ্ট এবং জবাবদিহিতার আওতাধীন।

অর্থ ব্যবস্থাপনার ব্যতিক্রমধর্মী পদ্ধতি:

অন্য রাজনৈতিক দলগুলো যেখানে কেন্দ্রীয় তহবিল থেকে নিচের ইউনিটগুলোতে টাকা পাঠায়, জামায়াতের ক্ষেত্রে দেখা যায় ঠিক উল্টোটা। জামায়াতের নিচের ইউনিটগুলো কেন্দ্রীয় ফান্ডে অর্থ পাঠায়। এই ব্যতিক্রমধর্মী পদ্ধতিটি তাদের অর্থ ব্যবস্থাপনায় একটি আলাদা বিশেষত্ব যোগ করে। এটি নিশ্চিত করে যে, দলের প্রত্যেকটি ইউনিট স্বতন্ত্রভাবে অর্থ সংগ্রহ করতে সক্ষম এবং তাদের নিজেদের খরচ মেটানোর পাশাপাশি কেন্দ্রীয় ফান্ডেও অবদান রাখতে পারে।

রাজনৈতিক ও আদর্শিক মিল:

জামায়াতে ইসলামী শুধু একটি রাজনৈতিক দল নয়, এটি একটি আদর্শিক দলও। তাদের আদর্শ এবং রাজনৈতিক লক্ষ্য ইসলামিক মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। দলটির প্রতিটি সদস্য ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর দৃঢ় বিশ্বাসী এবং তারা সেই আদর্শকে বাস্তবায়িত করার জন্য অর্থ সংগ্রহ থেকে শুরু করে মানবিক কার্যক্রম পর্যন্ত প্রতিটি ক্ষেত্রেই অবদান রাখে।

ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে জামায়াতের ভূমিকা:

জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে এবং অনেকেই মনে করেন যে, তাদের আদর্শ এবং রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি আগামী দিনের বাংলাদেশে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠবে। যদি বাংলাদেশের আলেম ওলামারা দলীয় মতভেদ ভুলে জামায়াতের সাথে একীভূত হতে পারেন, তবে জামায়াত ইসলামের নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে একটি নতুন যুগের সূচনা করতে পারে। তাদের নেতৃত্বের মধ্যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, উকিল, ব্যারিস্টার, জজ, প্রফেসর সহ নানা পেশার যোগ্য লোক রয়েছেন, যারা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম।

জামায়াতে ইসলামী একটি সুসংগঠিত দল যার অর্থ ব্যবস্থাপনা, জবাবদিহিতা এবং মানবিক সেবার ক্ষেত্রে তাদের কার্যক্রম বেশ প্রশংসনীয়। তাদের অর্থায়ন পদ্ধতির স্বচ্ছতা এবং সেবামূলক কার্যক্রম প্রমাণ করে যে, তারা শুধু রাজনৈতিক কার্যক্রমেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং মানবতার সেবায়ও নিবেদিত।


Thanks For Comment we are reply soon as possible.

Previous Post Next Post