নফস (نفس) শব্দটি একটি আরবী শব্দ, যার অর্থ প্রাণ বা আত্মা। ইসলামী ধর্মতত্ত্বে নফস এক অত্যন্ত গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। কুরআন ও হাদিসে নফসের বিভিন্ন ধরণের এবং অবস্থানের উল্লেখ পাওয়া যায়। নফসকে সাধারণত সেই প্রাণ বা আত্মা হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা আল্লাহ তাআলা মানুষের দেহে সঞ্চার করেছেন। এই নফসই মানুষের জৈবিক এবং আত্মিক শক্তির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করে। এটি মানুষের নৈতিক চরিত্র ও আচরণের সাথে সম্পর্কিত এবং এটি ভালো ও মন্দ উভয়েরই উৎস হতে পারে।
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তাআলা বলেছেন:
“কুল্লু নাফসিন জাইকাতুল মউত। অর্থাৎ, প্রত্যেক নফস তথা প্রাণ মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে।” (আল ইমরান: ১৮৫)
নফসের বিবরণ ইসলামী তত্ত্বে মূলত পাঁচটি ভিন্ন ধরণের নফসের রূপে আসে। প্রতিটি নফস মানুষের ভিন্ন ভিন্ন মানসিক ও আত্মিক অবস্থাকে প্রতিফলিত করে। এই পাঁচটি নফস হচ্ছে:
১. নফসে আম্বারাহ (প্রতারক আত্মা)
নফসে আম্বারাহ হলো সেই নফস, যা মানুষকে খারাপ কাজ ও পাপের দিকে প্ররোচিত করে। এটি মানুষের মধ্যে কুপ্রবৃত্তি, লালসা, এবং জৈবিক কামনার উদ্দীপনা সৃষ্টি করে। এই নফস নিজেই প্রতারক এবং নিজের কামনা-বাসনা ও ইচ্ছাগুলোকে বাস্তবায়িত করতে মানুষকে নানা ধরণের খারাপ কাজে লিপ্ত করে।
কুরআন আল কারিমে এই নফস সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন:
“আমি নিজের নফসকে দোষমুক্ত করছি না। নিশ্চয়ই নফস খারাপ কাজ করতে প্ররোচিত করে, তবে যদি কারোর প্রতি আমার রবের অনুগ্রহ হয় সে ছাড়া। নিশ্চয়ই আমার রব বড়ই ক্ষমাশীল ও দয়ালু।” (সূরা ইউসূফ: ৫৩)
নফসে আম্বারাহর চরিত্র হলো সর্বদা নিজের ইচ্ছা পূরণের জন্য কাজ করা। এটি এমন এক আত্মা, যা অনুশোচনা ছাড়াই মন্দ কাজে নিমজ্জিত হয়। একজন মানুষ যদি তার এই নফসকে দমন করতে না পারে, তবে সে পাপের অন্ধকারে ডুবে যায় এবং আল্লাহর প্রিয় থেকে দূরে চলে যায়।
২. নফসে লাওয়ামাহ (অনুশোচনাকারী আত্মা)
নফসে লাওয়ামাহ সেই নফস, যা খারাপ কাজের পর নিজের ভুল বুঝতে পারে এবং অনুশোচনা করে। এই নফসের বৈশিষ্ট্য হলো, পাপ করার পর এটি মানুষকে অনুশোচিত করে তোলে। যে ব্যক্তি এই নফসের অধিকারী, সে একদিকে পাপ করে, আবার অন্যদিকে তার অনুশোচনার কারণে পুনরায় আল্লাহর পথে ফিরে আসতে চায়।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
“আরও শপথ করছি নফসে লাওয়ামাহর, সেই মনের যা নিজেকে ধিক্কার দেয়।” (আল কিয়ামাহ: ২)
এই নফস মানুষকে গুনাহ থেকে মুক্তি পেতে সাহায্য করতে চায়। যদিও গুনাহে লিপ্ত হয়, তবু এই নফসের মালিক ব্যক্তি পুনরায় আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং তার ভুল শুধরে নিতে চায়। অনুশোচনাকারী আত্মা মানুষের হৃদয়ে এক ধরনের পেরেশানি তৈরি করে এবং তাকে আল্লাহর দিকে ফিরে আসার তাগিদ দেয়।
৩. নফসে মুতামায়িন্নাহ (প্রশান্ত আত্মা)
নফসে মুতামায়িন্নাহ সেই আত্মা, যা শান্ত ও পরিতৃপ্ত অবস্থায় থাকে। এটি সকল পাপ ও কামনা থেকে মুক্ত থাকে এবং আল্লাহর প্রতি পুরোপুরি বিশ্বাস ও আস্থাশীল হয়। এই নফসের মালিকের মধ্যে আর কোনো ভয় বা দুঃশ্চিন্তা থাকে না। তার জীবন সর্বদা আল্লাহর প্রতি সন্তুষ্টি ও পরম বিশ্বাসের মধ্যে কাটে।
আল্লাহ তাআলা বলেন:
“হে নফসে মুত্বমাইন্নাহ (প্রশান্ত মন), তুমি তোমার পালনকর্তার নিকট ফিরে যাও রদ্বিয়ান (সন্তুষ্ট) ও মারদ্বিয়্যান (সন্তোষভাজন) হয়ে। অত:পর আমার (নেক) বান্দাদের অর্ন্তভূক্ত হয়ে যাও। আর আমার জান্নাতে প্রবেশ কর।” (সূরা আল ফজর: ২৭-৩০)
এই নফসের ধাপ হলো পূর্ণ আত্মিক শান্তি ও স্থিতিশীলতা অর্জন করা। এ পর্যায়ে আসা ব্যক্তির হৃদয় এবং আত্মা আল্লাহর সাথে সম্পূর্ণভাবে সংযুক্ত থাকে এবং সে সর্বদা আল্লাহর সন্তুষ্টির উপর নির্ভরশীল হয়।
৪. নফসে মুলহিমাহ (ইলহামপ্রাপ্ত আত্মা)
নফসে মুলহিমাহ হলো সেই নফস, যা আল্লাহর পক্ষ থেকে ইলহাম (প্রজ্ঞা বা অন্তর্দৃষ্টি) প্রাপ্ত হয়ে পরিচালিত হয়। এই ধরণের আত্মা সবসময় আল্লাহর নির্দেশ ও জ্ঞানের উপর ভিত্তি করে কাজ করে এবং নিজস্ব কোনো ইচ্ছা বা অভিলাষ নেই। আল্লাহর দেওয়া ইলহাম দ্বারা পরিচালিত এই নফস সব ধরণের পাপ ও ভুল থেকে মুক্ত থাকে।
আল্লাহ বলেন:
“শপথ নফসের এবং যিনি তা সুবিন্যস্ত করেছেন-তাঁর, অতঃপর তাকে তার অসৎকর্ম ও সৎকর্মের ইলহাম (তথা জ্ঞান) দান করেছেন।” (সূরা আশ শামস: ৭-৮)
নফসে মুলহিমাহর অধিকারী ব্যক্তি আল্লাহর ইচ্ছার সাথে তার কাজগুলোকে সমন্বয় করে চলে। এই আত্মা ইচ্ছাশক্তি এবং সিদ্ধান্তের স্বাধীনতা ছাড়াই আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য কাজ করে। এটি পাপ পুন্যের ঊর্ধ্বে অবস্থান করে।
৫. নফসে রহমানিয়া (দয়ালু আত্মা)
নফসে রহমানিয়া হলো সেই আত্মা, যা আল্লাহর দয়া ও করুণার সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছায়। এই আত্মা আল্লাহর সাথে সংযুক্ত হয়ে, সর্বদা তাঁর অনুগ্রহ ও দয়া দ্বারা পরিচালিত হয়। এর মাধ্যমে এক সাধক আল্লাহর সাথে গভীর সম্পর্ক স্থাপন করে এবং নিজেকে আল্লাহর আদেশের প্রতি সম্পূর্ণ সমর্পিত করে দেয়।
আল্লাহ বলেন:
“বল, আমরা আল্লাহর রং গ্রহণ করেছি। আর রংয়ের দিক থেকে আল্লাহর চেয়ে কে অধিক সুন্দর? আর আমরা তারই ইবাদতকারী।” (সূরা আল বাকারা: ১৩৮) নফসে রহমানিয়া অর্জনকারী ব্যক্তি আল্লাহর অসীম দয়া ও করুণার অধিকারী হয়। সে নিজের ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছার সাথে সম্পূর্ণরূপে মিশিয়ে দেয়, এবং তার সমস্ত কর্ম আল্লাহর সন্তুষ্টির উদ্দেশ্যে হয়।