প্রটেস্টান্ট রিফর্মেশন এবং ক্যাথলিক চার্চের বিরোধিতা: ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি

প্রটেস্টান্ট রিফর্মেশন ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা খ্রিস্টান ধর্মের ভিতরেই বিশাল পরিবর্তনের সূচনা করেছিল। এটি ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ হিসেবে শুরু হয়েছিল এবং খ্রিস্টান ধর্মের মধ্যে অনেক নতুন মতবাদ এবং পন্থার জন্ম দিয়েছে। মুসলিম হিসেবে, প্রটেস্টান্ট রিফর্মেশন নিয়ে আমাদের অবস্থান কেমন হওয়া উচিত, এটি একটি চিন্তার বিষয়। আপাতভাবে মনে হতে পারে যে, প্রটেস্টান্টদের চার্চের ভূমিকাকে প্রশ্ন করা এবং সরাসরি স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার ধারণা ইসলামের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আবার ক্যাথলিক চার্চের ঐতিহ্য এবং প্রথার সাথে ইসলামী ইলমের সিলসিলারও কিছুটা সাদৃশ্য থাকতে পারে। তবে শুধু বাহ্যিক মিলের ওপর ভিত্তি করে উপসংহার টানা সঠিক হবে না। বরং, ইসলামের দৃষ্টিকোণ থেকে দুই পক্ষেরই ত্রুটি খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

ক্যাথলিক চার্চের শিক্ষা ও ইসলাম

ক্যাথলিক চার্চের বিভিন্ন কার্যকলাপ এবং শিক্ষা ইসলামের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। তাদের অন্যতম বিতর্কিত ধারণা ছিল 'ইন্ডালজেন্স' (indulgence), যার মাধ্যমে চার্চ আর্থিক অনুদান বা বিশেষ কাজের বিনিময়ে পাপ মুক্তি ও ক্ষমা প্রদান করত। মানুষের জন্য কোনো নৈতিক পরিবর্তন ছাড়াই পাপের মুক্তি পাওয়া সম্ভব হতো, যদি তারা চার্চকে অর্থ প্রদান করত বা চার্চের নির্দেশিত কিছু কাজ করত, যেমন ক্রুসেডে অংশগ্রহণ করা। এটি ছিল চার্চের সম্পদ বৃদ্ধির একটি পদ্ধতি, যা ইসলামের শিক্ষা অনুযায়ী সম্পূর্ণভাবে অনৈতিক।

ইসলামে, পাপের মুক্তি শুধুমাত্র আল্লাহর কাছে তওবার মাধ্যমে সম্ভব, যা অন্তরের প্রকৃত অনুশোচনা এবং সংশোধনের সাথে সম্পর্কিত। কোনো আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে পাপ মুক্তি সম্ভব নয়। পাপের পরিণতি আল্লাহ নির্ধারণ করেন, এবং এটি কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। সুতরাং, ক্যাথলিক চার্চের এই দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামের মৌলিক শিক্ষা থেকে বিচ্যুত।

প্রটেস্টান্ট রিফর্মেশন ও ইসলামের সাথে মিল

প্রটেস্টান্ট রিফর্মেশনের মূল উদ্দেশ্য ছিল ক্যাথলিক চার্চের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। প্রটেস্টান্টদের মতে, চার্চ নিজেই পাপী এবং ঈশ্বরের নামে মানুষের ওপর অন্যায় করে আসছে। এই বিদ্রোহের মাধ্যমে তারা পুরোহিতদের মাধ্যমে মানুষের জন্য ঈশ্বরের কাছে যাওয়ার মধ্যস্থতাকারী ভূমিকা বাতিল করার প্রচেষ্টা করেছিল। এখানে ইসলামের সাথে একটি আপাত মিল দেখা যায়, কারণ ইসলামে কোনো পোপ, পুরোহিত, বা কবরের মাধ্যমে আল্লাহর কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ইসলাম সরাসরি আল্লাহর সাথে সম্পর্ক স্থাপনের শিক্ষা দেয়।

কুরআনে বলা হয়েছে:

‘তারা আল্লাহকে ছেড়ে তাদের পণ্ডিত ও সংসার-বিরাগীদের রব হিসেবে গ্রহণ করেছে।’
[সূরা আত তাওবাহ, ৯:৩১]

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) বলেন, মানুষ যখন তাদের ধর্মীয় নেতাদের হালাল বা হারামের ফতোয়া গ্রহণ করে, তারা মূলত তাদের উপাসনা করে। এইভাবে ইসলামের দৃষ্টিতে, পুরোহিততন্ত্র শিরকের পর্যায়ে পৌঁছে যেতে পারে। কাজেই, প্রটেস্টান্টদের পুরোহিতদের বিরোধিতা ইসলামিক ভাবনার সাথে কিছুটা সামঞ্জস্যপূর্ণ বলে মনে হতে পারে।

প্রটেস্টান্টদের চরম আপেক্ষিকতা: ইসলামের প্রতিক্রিয়া

তবে, প্রটেস্টান্টদের 'Priesthood of all believers' ধারণাটি ইসলামের দৃষ্টিতে সমস্যাযুক্ত। এই ধারণা অনুযায়ী, প্রতিটি বিশ্বাসী নিজেই ধর্মীয় টেক্সটের ব্যাখ্যা করতে পারে এবং শরীয়াহর নিয়ম নির্ধারণ করতে পারে। ইসলামে, এটি একটি গ্রহণযোগ্য পথ নয়। কারণ, এই চরম রিলেটিভিস্টিক অবস্থান দ্বীনের মূল শিক্ষাকে বিকৃত করে এবং ধর্মীয় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে পারে।

রাসূলুল্লাহ (ﷺ) সতর্ক করেছেন যে, দ্বীনের ব্যাপারে অজ্ঞতার ভিত্তিতে কথা বলা ইসলামে বিপজ্জনক। প্রত্যেকে নিজে নিজে ফতোয়া দেয়া বা কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা করতে পারে না। ইসলামে ইলমের একটি ধারাবাহিকতা ও বর্ণনাসূত্র আছে, যা নিশ্চিত করে যে, কোনো ব্যাখ্যা সঠিক কিনা তা যাচাই করা সম্ভব।

ইসলাম: সঠিক পথের নির্দেশনা

ইসলামে, হাদীসের ইসনাদ বা বর্ণনাসূত্র এবং সালাফুস সালিহিনদের শিক্ষার ভিত্তিতে দ্বীনের ব্যাখ্যা নিশ্চিত করা হয়। হাদীস এবং প্রথম তিন প্রজন্মের শিক্ষার মাধ্যমে উম্মাহর জন্য একটি স্থায়ী এবং নির্ভরযোগ্য মানদণ্ড তৈরি হয়েছে, যা ধর্মের মধ্যে নতুন কোনো ধারণা বা অপব্যাখ্যা প্রবেশের পথ বন্ধ করে।

সুতরাং, আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ এই দুই প্রবণতা – ক্যাথলিকদের পুরোহিততন্ত্র এবং প্রটেস্টান্টদের আপেক্ষিকতা – উভয়ই এড়িয়ে চলে। ইসলামে, সব মুমিন আল্লাহর কাছে সমান এবং সরাসরি আল্লাহর ইবাদত করতে পারে, তবে দ্বীনের ব্যাখ্যা এবং ফতোয়ার জন্য আহলুল ইলমের কাছে যেতে হবে। এভাবেই ইসলাম পুরোহিততন্ত্র এবং চরম আপেক্ষিকতা থেকে মুক্ত থাকে।

প্রটেস্টান্ট রিফর্মেশন: ইসলামিক শিক্ষার আলোকে

প্রটেস্টান্ট রিফর্মেশনের ইতিবাচক দিক ছিল ক্যাথলিক চার্চের দুর্নীতি এবং বিভ্রান্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করা। তবে, তাদের আরও একটি মূল সমস্যা ছিল সত্যের একটি অংশ গ্রহণ করে বাকী অংশ প্রত্যাখ্যান করা। শাইখ আব্দুল আযীয আত-তারিফীর মতে, প্রটেস্টান্টরা ক্যাথলিক চার্চের ভুল শিক্ষাকে প্রত্যাখ্যান করলেও, তারা সত্যিকার তাওহীদের শিক্ষা গ্রহণ করেনি। তারা ইসলামের বিশুদ্ধ তাওহীদ এবং রাসূলুল্লাহ (ﷺ)-এর নবুয়াতকে স্বীকার করেনি। তাই তাদের প্রতিবাদ, যদিও আংশিকভাবে যৌক্তিক ছিল, সম্পূর্ণ সত্যের সাথে মিলিত হয়নি।

মুসলিমদের জন্য প্রটেস্টান্ট রিফর্মেশনের দিকে তাকানোর সময় বুঝতে হবে যে, এই আন্দোলনের মধ্যে কিছু যৌক্তিকতা এবং ন্যায়সঙ্গত বিরোধিতা ছিল, তবে তাদের ধর্মীয় শিক্ষার মূল ভিত্তি ইসলামের সাথে সরাসরি সাংঘর্ষিক। ইসলাম, প্রটেস্টান্টদের মতো 'Priesthood of all believers'-এর ধারণাকে প্রত্যাখ্যান করে, এবং একই সাথে ক্যাথলিক চার্চের পুরোহিততন্ত্রের চরম ক্ষমতার অপব্যবহারকেও। ইসলামে, সঠিক শিক্ষা এবং ব্যাখ্যা সিলসিলার মাধ্যমে সংরক্ষিত থাকে, যা উম্মাহকে পথভ্রষ্টতা থেকে রক্ষা করে।


Thanks For Comment we are reply soon as possible.

Previous Post Next Post