জাতীয়তাবাদ একটি ভ্রান্ত ধর্ম

জাতীয়তাবাদকে একটির ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করার ধারণা নতুন নয়। ইতিহাসে বহু চিন্তাবিদ, দার্শনিক এবং রাজনীতিবিদ জাতীয়তাবাদের মধ্যে ধর্মীয় গুণাবলী খুঁজে পেয়েছেন। ধর্মের মতো জাতীয়তাবাদেও রয়েছে নির্দিষ্ট প্রতীক, আচার-অনুষ্ঠান, বিশ্বাস ও মূল্যবোধ। এ ধারার অনুসারীরা তাদের দেশের প্রতি যে ভক্তি এবং আনুগত্য প্রকাশ করে, তা প্রায় ধর্মীয় আকার ধারণ করে। এ লেখায় জাতীয়তাবাদকে ধর্ম হিসেবে উপস্থাপন করা এবং এর সাথে ধর্মীয় বিশ্বাস ও আচরণের তুলনামূলক আলোচনা করা হবে যেনো  জাতীয়তাবাদ নামে এই ভ্রান্ত ধর্ম থেকে আমরা রক্ষা পেতে পারি। যে বা যারা জাতীয়তাবাদ ভ্রান্ত ধর্মে বিশ্বাসী প্রতিটা ব্যক্তি আল্লাহর সার্বভৌমত্ব অস্বীকার করলো। 

১. জাতীয়তাবাদের প্রতীক এবং আচার-অনুষ্ঠান

ধর্মের মতোই জাতীয়তাবাদেরও রয়েছে নির্দিষ্ট প্রতীক ও আচার-অনুষ্ঠান। একটি দেশের পতাকা জাতীয়তাবাদের মূল প্রতীকগুলির একটি। পতাকা সমাজে পবিত্রতা এবং ভক্তির সাথে দেখা হয়। পতাকাকে অসম্মান করার ঘটনা অনেক সময় আইনের আওতায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। ধর্মীয় প্রতীক যেমন ক্রুশ, তাসবিহ বা গীতা সম্মানের সাথে রাখা হয়, তেমনি জাতীয় পতাকাও সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় জীবনে অতি সম্মানের অধিকারী। পতাকার সাথে থাকে জাতীয় সংগীত, যা একপ্রকার ধর্মীয় স্তোত্রের মতো শ্রদ্ধা এবং ভক্তি সহকারে গাওয়া হয়। জাতীয় সঙ্গীত পরিবেশিত হলে দাঁড়িয়ে সম্মান জানানো যেন এক ধরনের ইবাদাত। এ সম্মান প্রদর্শন জাতীয়তাবাদের প্রতি আনুগত্যের প্রকাশ।

পাশাপাশি জাতীয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস বা বিজয় দিবসের মতো দিনগুলো জাতীয়তাবাদের পবিত্র দিন হিসেবে পালিত হয়। এসব দিনে যেমন এক মিনিটের নীরবতা পালন করা হয়, তেমনি বিভিন্ন দেশপ্রেমমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করতে হয়। জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দেয়া, শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা—এসব কর্মকাণ্ড ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানের মতোই সম্মানের সাথে পালন করা হয়। এগুলোর মাধ্যমে জনগণের মধ্যে রাষ্ট্র ও জাতির প্রতি আবেগ ও আনুগত্য গভীরভাবে গেঁথে যায়। কেউ যদি এগুলো অশিক্ষিত করে তাহলে তাকে আইনের আওতায় না হয় এ যেন তাদের ধর্ম বাণীর বিরুদ্ধে যাওয়া। 

২. জাতীয়তাবাদের সৃষ্টিতত্ত্ব

প্রতিটি ধর্মেরই একটি সৃষ্টিতত্ত্ব থাকে—বিশ্বাস থাকে যে কোনো মহান ঘটনার মাধ্যমে তাদের ধর্মের জন্ম হয়েছে। জাতীয়তাবাদেও তেমনি একটি সৃষ্টিতত্ত্ব বিদ্যমান থাকে। কোনো যুদ্ধ, বিপ্লব, আন্দোলন অথবা আত্মত্যাগের মাধ্যমে রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে বলে বিশ্বাস করা হয়। এই সৃষ্টিতত্ত্বকে প্রশ্ন করা যায় না; এটি এমন এক সত্য যা যুক্তি ও তথ্যের ঊর্ধ্বে থাকে। এমনকি ইতিহাসের বাস্তবতাকেও জাতীয়তাবাদী সৃষ্টিতত্ত্বের সামনে ম্লান করে দেয়া হয়। উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়, ফরাসী বিপ্লবীরা তাদের প্রজাতন্ত্রকে সমগ্র ইউরোপের কাছে সাম্য, স্বাধীনতা এবং ভ্রাতৃত্বের বার্তা পৌঁছে দেয়ার পবিত্র দায়িত্বে নিযুক্ত বলে মনে করত। আমেরিকানরা বিশ্বাস করে যে তাদের গণতন্ত্র, পুঁজিবাদ এবং স্বাধীনতা ছড়িয়ে দেয়া বিশ্বের প্রতি তাদের ঈশ্বরপ্রদত্ত কর্তব্য।

জাতীয়তাবাদীদের মধ্যে এ ধরনের সৃষ্টিতত্ত্বের কারণে তাদের রাষ্ট্রের প্রতি এক ধরনের চিরন্তন দায়িত্ববোধ তৈরি হয়। রাষ্ট্র শুধু অর্থনৈতিক, সামাজিক বা অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য নয়, বরং আরও গভীর কোনো চেতনা বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে তারা মনে করে। এটি তাদের জাতির প্রতি এক ধরনের পবিত্র কর্তব্যে পরিণত হয়।

৩. জাতীয়তাবাদী ধর্মতত্ত্ব

জাতীয়তাবাদের পেছনে থাকা চিন্তাবিদ এবং বুদ্ধিজীবীরা বিশদভাবে ইতিহাস এবং রাষ্ট্রের বিকাশ নিয়ে গবেষণা করেন। তারা বিভিন্ন ঘটনা বিশ্লেষণ করে রাষ্ট্রের জন্য শিক্ষণীয় দিক খুঁজে বের করেন। তাদের গবেষণা এবং বিশ্লেষণ সাধারণ মানুষের কাছে সহজভাবে তুলে ধরা হয়—পাঠ্যবই, প্রবন্ধ, বা গণমাধ্যমের মাধ্যমে। শিল্প-সাহিত্য, টিভি, সিনেমা, এবং সোশ্যাল মিডিয়া এসব বিশ্লেষণকে সহজ করে জনসাধারণের বোধগম্য করে তোলে।

এভাবে জাতীয়তাবাদের তত্ত্বগুলো একধরনের পুরাণে পরিণত হয়, যা সমাজের মূল ধারার মধ্যে প্রবাহিত হয়। জাতীয়তাবাদের প্রচার এবং প্রসারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য আরও গভীরভাবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়। এর মাধ্যমে মানুষ নিজেদের পরিচয় রাষ্ট্রের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত করে ফেলে।

৪. রাষ্ট্র এবং জাতির প্রতি আনুগত্য

জাতীয়তাবাদের ধর্মে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য এবং বশ্যতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যেমন ইসলামে আল্লাহর প্রতি আনুগত্য ফরয, তেমনি জাতীয়তাবাদে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য অপরিহার্য। রাষ্ট্রদ্রোহিতা জাতীয়তাবাদে সবচেয়ে গুরুতর অপরাধ হিসেবে গণ্য হয়। কোনো ব্যক্তি যদি প্রকাশ্যে রাষ্ট্রের বিরোধিতা করে, তাকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। অনেক সময় সন্দেহভাজনদেরও বিশেষ নজরে রাখা হয় এবং রাষ্ট্রের প্রতি তাদের আনুগত্য পরীক্ষা করা হয়।

জাতীয়তাবাদের ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে যারা রাষ্ট্রের প্রতি কম আনুগত্য দেখায়, তাদের সমাজে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক হিসেবে দেখা হয়। তারা নিয়মিতভাবে দেশপ্রেমের পরীক্ষা দিতে বাধ্য হয়। অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের সন্দেহভাজনদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র বা নাশকতার অভিযোগও আনা হয়।

৫. জাতীয় বীর এবং তীর্থস্থান

জাতীয়তাবাদের ধর্মে জাতীয় বীর, নেতা, এবং বিপ্লবীদের এক ধরনের ধর্মীয় মর্যাদা দেয়া হয়। জাতির পিতা, জাতীয় বীরদের স্মরণ করা হয় ধর্মীয় মহাপুরুষদের মতো। তাদের জীবনী, আত্মত্যাগ, এবং অবদান জাতীয়তাবাদের অনুপ্রেরণার উৎস। বিভিন্ন দেশের ঐতিহাসিক স্থান এবং স্মৃতিসৌধ জাতীয় তীর্থস্থানে পরিণত হয়, যেখানে জাতির সন্তানরা শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসে।

জাতীয়তাবাদের অনুসারীরা যেমন রাষ্ট্রের প্রতীকগুলোর প্রতি আনুগত্য দেখায়, তেমনি তারা জাতীয় বীরদের প্রতি ভক্তি প্রকাশ করে। জাতীয় তীর্থস্থানগুলোতে রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য এবং বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন যেন ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মতো পালিত হয়।

জাতীয়তাবাদকে ধর্ম হিসেবে বিবেচনা করলে, এর মধ্যে ধর্মের প্রায় সব বৈশিষ্ট্যই পাওয়া যায়—বিশ্বাস, প্রতীক, আচার-অনুষ্ঠান, সৃষ্টিতত্ত্ব এবং আনুগত্য। রাষ্ট্র সর্বোচ্চ ক্ষমতাধারী এবং সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ হিসেবে মান্য করা হলে, রাষ্ট্র কার্যত একপ্রকার ইলাহ হিসেবে প্রতিষ্ঠা পায়। এই ধর্মের অনুসারীরা রাষ্ট্রের প্রতি গভীর আনুগত্য এবং ভক্তি প্রকাশ করে। যেভাবে ধর্মীয় অনুসারীরা তাদের ধর্মীয় প্রতীক ও বিশ্বাসের প্রতি আনুগত্য দেখায়, তেমনি জাতীয়তাবাদীরাও তাদের রাষ্ট্র এবং জাতির প্রতি দেখায় চূড়ান্ত আনুগত্য।


Thanks For Comment we are reply soon as possible.

Previous Post Next Post